হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ)


হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহঃ)




হযরত জুনায়েদ ইরাকের বাগদাদ নগরীর অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন পীরানে-পীর এবং মা’রিফাতের বাদশাহ তুল্য। তিনি যবরদ্স্ত আলেম ও মুফতী এবং ধর্মীয় বহু শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। অমিয় উক্তি এবং সূক্ষ্ম ঈঙ্গিতপূর্ণ বাণী করতে তাঁর সমতুল্য কেউ ছিল না। প্রথম হতে শেষ পযর্ন্ত তিনি সকলের নিকট সম্মানিত ছিলেন। তাঁর পূর্বাপর সকল অবস্থা সকলের নিকট আদরণীয় ও প্রশংসনীয় ছিল এবং তিনি দল-মত নির্বশেষে সকলের ইমামরূপে বরেণ্য
ছিলেন। তাঁর বাণী তরিকত শাস্ত্রে দলীলরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। সকলের মুখেই তাঁর প্রশংসা শোনা যায়। কেহই তাঁর যাহেরী ও বাতেনী ইলমে দোষারোপ করতে পারেনি। তিনি সুফীদের সরদার ও নেতা ছিলেন। তাঁকে ‘লেসানুল কওম’ বা জাতির মুখপাত্র বলা হত। তিনি নিজেকে ‘আবদুল মাশায়েখ’ অর্থাৎ পীরদের খাদেম বলে নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাঁকে ‘তাওসুল উলামা’ এবং ‘সুলতানুল মুহাক্কেকীন’ও বলা হতো। তিনি শরীয়ত, তরীকত ও হাকীকতের গভীর তলদেশে পৌঁছে ছিলেন। তিনি ‘ইশক’ (প্রেম) ও যোহদে (সাধনায়) অতুলনীয় ছিলেন। তিনি তরীকতের যুগ-প্রবর্তক ইমাম ছিলেন। বহু মাশায়েখ তাঁর মাযহাবের অন্তর্ভূক্ত হন। তরীকতে তাঁর মাযহাবই সবচেয়ে বড় এবং মশহুর (বিখ্যাত)। সে সময়ে তিনি সকল মাশায়েখের কেন্দ্রস্থল ছিলেন। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। মা’রিফাত তাঁর সাহায্যেই বিস্তৃতি লাভ করে, এটা বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। তাঁর এই উচ্চ মযার্দা ও অসীম গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও হিংসুটে দুশমনরা তাঁকে কাফের ও যিন্দিক বলতেও কুন্ঠিত হতো না। তিনি হযরত মুহাসেবীর (রহঃ)ও সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তিনি হযরত সররী সকতীর (রহঃ) ভাগিনা ছিলেন। একবার হযরত সররী সকতী (রহঃ)-কে লোকে জিজ্ঞেস করেছিল, “কোনও মুরীদ কি পীরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে’’ ? হযরত সররী সকতী (রহঃ) বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয় ! তার প্রকাশ্য প্রমাণ ত এটাই যে, জুনায়েদের পদ ও মযার্দা আমার চেয়ে অনেক উচ্চে”।



ছেলেবেলা হতেই জুনায়েদ অত্যন্ত সাবধান, তীক্ষ্ম-বুদ্ধিমান এবং আল্লাহ্ প্রেমিক ছিলেন। একবার বাল্যকালে জুনায়েদ মাদ্রাসা হতে ঘরে ফিরছিলেন, পথে দেখলেন তাঁর পিতা কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁর পিতা বললেন, “আমি আজ কিছু যাকাতের মাল তোমার মামা সররীর কাছে পাছিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি তা গ্রহন করেন নি। আমি এজন্য কাঁদছি। কারণ আমি সারাজীবনে এই পাঁচ হাজার দিরহাম হালাল উপায়ে রোযগার করেছি। তবুও তোমার মামা এ হালাল দিরহামের পাঁচটি দিরহামকেও পছন্দ করলেন না এবং তা প্রত্যাখ্যান করলেন”। একথা শুনে জুনায়েদ বললেন, “আব্বা, এগুলো আমাকে দিন, আমি এখনই মামাকে দিয়ে আসব”। তারপর তিনি এই মুদ্রাগুলো নিয়ে মামা সররীর দরজায় উপস্থিত হলেন। দরজা বন্ধ দেখে শিকল ধরে টানলেন। হযরত সররী সকতী (রহঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “কে ?” উত্তরে বললেন, “আমি জুনায়দ, দরজা খুলুন এবং এই যাকাতের দিরহামগুলি রেখে দিন”। হযরত সররী বললেন, “অামি এই যাকাতের মাল রাখব না”। জুনায়েদ বললেন, “সেই আল্লাহ্‌র কসম দিয়ে বলছি, যিনি আপনার প্রতি অনুগ্রহ এবং ‍আমার আব্বার প্রতি ন্যায় বিচার করেছেন”। সররী (রহঃ) বললেন, “হে জোনায়েদ ! আমার ওপর কি অনুগ্রহ করা হয়েছে এবং তোমার আব্বার প্রতি কি ন্যায় বিচার করা হয়েছে” ? জুনায়েদ বললেন, “আল্লাহ্‌ আপনাকে দুনিয়াদারী থেকে মুক্ত করে আল্লাহ্‌র কাজে লিপ্ত রেখে পরকালের ধনে ধনী করে আপনার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আর আমার আব্বাকে দুনিয়ার ধনে ধনী করে দুনিয়ার কাজে লিপ্ত রেখেছেন, এটা তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার। এখন আপনার ইচ্ছা হয় গ্রহন করুন অথবা ফিরিয়ে দিন। তবে উপযুক্ত পাত্রে যাকাত পাঠিয়ে দেয়া আমার আব্বার কর্তব্য”। হযরত সররী সকতী (রহঃ) একথা শুনে অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “বাবা, যাকাত গ্রহনের আগে আমি তোমাকেই সাদরে গ্রহন করছি”। এই বলে দরজা খুলে তিনি যাকাত গ্রহন করে জুনায়েদকে আদরের সাথে হৃদয়ে স্থান দিলেন।



জুনায়েদের বয়স ৭ বছর হলে হযরত সররী সকতী তাকে হ্জ্জ্ব করতে মক্কা শরীফ নিয়ে যান। সে সময় কাবা শরীফে চারিশত পীর মাশায়েখ জমায়েত হয়েছিলেন। একদিন সেখানে শোকর (কৃতজ্ঞতা) সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত প্রকাশ করলেন। হযরত সররী সকতী জুনায়েদকে বললেন, “বাবা, তুমিও কিছু বল”। জুনায়েদ কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে করে পরে আজীজির সাথে বললেন, “আল্লাহতা’য়ালা আমাদেরকে যে নেয়ামত দান করেছেন, সে নিয়ামত পেয়ে যেন তাঁর অবাধ্য নাফরমান না হই এবং তাঁর নিয়ামতকে গোণাহের কারণ বা উপকরণ না করি- তাই শোকর”। একথা শুনে পীর-মাশায়েখরা বললেন, “হে আমাদের নয়নের মনি ! তুমিই উত্তম বলেছ, যথার্থ সত্য বলেছ”। হযরত সররী সকতী বললেন, “বাবা, তুমি এরূপ কথা কোথা থেকে শিক্ষা করলে ?” জুনায়েদ উত্তরে বললেন, “আপনার সোহবতের (সান্নিধ্যের) বদৌলতে”। তিনি বাগদাদে কাচেঁর ব্যবসা করতে লাগলেন। প্রতিদিন দোকানে গিয়ে পর্দার আড়ালে থেকে চারশত রাকাত নামায পড়তেন। এভাবে কিছুদিন চলার পড়ে তিনি ব্যবসা ছেড়ে দিলেন এবং হযরত সররী সকতীর ঘরের সম্মুখস্থ একটি চিলে কোঠায় বসে আল্লাহ্‌র জিকর (স্মরণ) এবং আত্মসংযমে মশগুল হলেন। ক্রমে জিকরে এতই নিমগ্ন হলেন যে, কখনও ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি আসনের নিম্নভাগ হতে মুছাল্লা সরিয়ে ফেলতেন যাতে তার অন্তরে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কিছুর খেয়ালও না আসতে পারে।



এইরূপে তিনি চল্লিশ বছর যিকিরে কাটিয়েছিলেন। ত্রিশ বছর যাবত ইশার নামাযের পর দাঁড়িয়ে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে থাকতেন এবং সেই ওযু দিয়েই ফজরের নামায আদায় করতেন। তিনি বলেন, “এভাবে চল্লিশ বছর কেটে যাওয়ার পরে আমি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছি বলে ধারণা জন্মে”। আর তখনই গায়েবী আওয়াজ শুনলাম যে, “হে জুনায়েদ, এখন তোমার ভুতপরস্তির (মূতির্পূজার) সময় এসেছে”। আমি গায়েবী আওয়াজ শুনে বললাম, “জুনায়েদের কি গোণাহ্ হল ?” তখনই শোনা গেল, “তুমি এখনও আছ, এখনও তুমি নিজেকে ডুবিয়ে দাও নি ? এটা অপেক্ষা তুমি আর কি গোনাহ চাও ?” জুনায়েদ এক সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে লজ্জায় মাথা নত করে বললেন, “হায় ! যে এখনও মাশুকের (প্রেমিকের) মিলনের অনুপযুক্ত, বস্তুত প্রত্যেক নেক কাজই তার গোনাহ তুল্য বটে”।



তারপর হতে পুণরায় তিনি সেই ঘরে নির্জন বাস করতে লাগলেন। সারারাত তিনি সেখানে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতেন। বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর এই কাজের বিরোধী হয়ে খলীফার দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করলে খলীফা বললেন, “বিনা প্রমাণে তাঁকে তাঁর আপন কাজে বাধা দেয়া যায় না”। বিরুদ্ধবাদীরা বলল, “জনসাধারণ তাঁর উল্টাপাল্টা কথায় ও কাজে ধোঁকায় পড়ে বিপথগামী হচ্ছে। কাজেই তাঁকে শাসন করা দরকার”। এই কথা শুনে খলিফা গোপনে জুনায়েদকে পরীক্ষা করার সংকল্প করেন। তিন হাজার দিরহাম মূল্যে ক্রয় করা খলিফার একটি অতীব সুন্দরী দাসী ছিল। সে যুগে এমন অপরূপা সুন্দরী আর দ্বিতীয়টি ছিল না। স্বয়ং খলিফা নিজেই তার প্রতি আসক্ত ছিলেন। এক রাতে মহামূল্যবান অলংকার ও মনিমুক্তা খচিত পোষাক পড়িয়ে খলিফা তাকে হুকুম করলেন, “তোমাকে অমুক স্থানে হযরত জুনায়েদের কাছে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে অপরূপ ভঙ্গিমায় জুনায়েদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করবে এবং বলবে যে-- আমার প্রচুর ধন-সম্পত্তি আছে, কিন্তু বতর্মানে আমার দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে। তাই আমি এই বাসনা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি যে, দয়া করে আপনি আমাকে নিজ সান্নিধ্যে স্থান দান করবেন। আমি আপনার সাথে থেকে বাকী জীবনটা আল্লাহ্‌র ইবাদতে কাটিয়ে দিতে চাই। এখন আমার মন একমাত্র এটাই চায় যে, আপনাকে ছাড়া আর কাহারও কাছে বসবও না।” সুন্দরী বাঁদীকে এটাও বলে দিলেন যে, যতদূর পার যত্ন-আত্তি ও তোষামোদ করে জুনায়েদকে ভুলাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করো না। এই কথা বলে খলিফা বাঁদীকে বিদায় দিলেন এবং ঘটনা কি ঘটবে জানার জন্য বুদ্ধিমান একটি গোলামকেও সাথে পাঠালেন।



সুন্দরী বাঁদী পরিকল্পনা মতো জুনায়েদের কাছে পৌঁছেই মুখের ঘোমটা খুলে ফেলল। ঘটনাক্রমে জুনায়েদের নজর হঠাৎ একবার তার ওপর পড়তেই তিনি মাথা নীচু করে ফেললেন। বাঁদীকে যে-সব কথা কথা বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার সবই সে জুনায়েদকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল। ভদ্রতা, বিনয়, খোষামোদ, পীড়াপীড়ি ইত্যাদি কোনটাই সে করতে ছাড়েনি। জুনায়েদ নত মুখেই বাঁদীর সকল কথা শুনে অবশেষে মাথা উঠিয়ে “আহ্ আহ্” (হায় ! হায় !) বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আর সাথে সাথেই বাঁদী বেহুঁশ হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করে। চাকরটি দৌঁড়ে গিয়ে খলীফাকে এই সংবাদ জানাল। খলীফা দুঃখিত হলো বলল, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র আশেকের সাথে এমন আচরণ করবে যা করার মতো নয়, তবে তার ফলাফলও এমন দেখবে যা দেখার মতো নয়”। সাথে সাথেই উঠে খলীফা স্বয়ং জুনায়েদের খিদমতে হাজির হলেন। লোকে খলীফাকে স্বয়ং সেখানে যেতে নিষেধ করে বরং জুনায়েদকে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে পরামর্শ দিল। কিন্তু খলীফা বললেন, “এমন মান্যবর বুজুর্গ ব্যক্তিকে দরবারে তলব করা উচিত নয়, বরং নিজেই তাঁর দরবারে যাওয়া কর্তব্য”।



খলীফা গিয়ে বিনয়ের সাথে হযরত জুনায়েদকে বললেন, “হুজুর, এমন সুন্দরের উপমাকে ছাড়খার করতে আপনার মন সায় দিলো” ? জুনায়েদ বললেন, “আমীরুল মোমেনীন, মোমিনদের প্রতি কি আপনার এমনই মেহেরবানী যে, আপনি ইচ্ছা করলেন, আমার চল্লিশ বছরের ঘুম হারাম করা সকল বন্দেগী-সাধনার ফল একজন বাঁদী বরবাদ করুক ! আর আমি এই (মৃত্যুর) ব্যাপারে কে ? আমার ক্ষমতাই বা কি ? নগণ্য ব্যক্তি আমি, যদি কাহাকেও এসব করতে নিষেধ করতাম, তবে কে আমার কথা শুনত ! যা হোক, আপনি ভবিষ্যতে এমন কাজ করবেন না।” এরপর ‍জুনায়েদ আরও উন্নতি করলেন। সারা দুনিয়ায় তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। যেই বিষয়ে জুনায়েদকে পরীক্ষা করা হলো, তিনি এটা অপেক্ষা হাজার গুণ অধিক বুজুর্গ বলে প্রমাণিত হলেন। ইহার পর মহাত্মা জুনায়েদ জনসম্মুখে ওয়াজ করতে আরম্ভ করলেন। একদিন তিনি বললেন যে, “পর পর চল্লিশজন আব্‌দাল আমাকে ওয়াজ করতে অনুরোধ ও বাধ্য করার পর আমি ওয়াজ করতে আরম্ভ করেছি। আমি দুইশত পীরের খিদমত করেছি, যাদের সকলেই অনুসরণের যোগ্য”। তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র বাণী কোরআন শরীফকে ডান হাতে এবং রাসুলুল্লাহর বাণী সুন্নাহ্‌কে বাম হাতে নিয়ে উভয় বাতির আলোকে পথ চলে, কোন সন্দেহের গর্তে না পড়ে বা বিদআতের অনুসারী না হয়, এমন ব্যক্তিরই দরবেশীর পথে পা বাড়ানো কর্তব্য”।



তিনি বলেন যে, “হযরত আলী কার্‌রামাল্লাহু মারিফাতের মৌলিক তত্ত্ব ও শাখাসমূহের এবং কষ্টসহিষ্ণুতার দরজা খুলে দিয়েছেন। আল্লাহ্ পাক তাঁকে বিবিধ জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যদি একটি কথা না বলতেন তাহলে তরীকতপন্থীগণ এখন না জানি কি করতেন ! সেই সার কথাটি হলো ‍ঃ “লোকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কিভাবে আল্লাহ্ পাককে চিনতে পেরেছেন ?” উত্তরে হযরত ‍আলী (রাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ্ পাক নিজে আমাকে আত্মপরিচয়ে অবহিত করেছেন যে, তিনি এমন সত্ত্বা, যাঁর দ্বিতীয় তুলনাও হতে পারে না। কোন আকৃতি দিয়ে তাঁকে কল্পনা করা চলে না, কোন সৃষ্টির উপর তাঁকে অনুমান করা যায় না”। তিনি বহু দূরে হলেও নিকটে, নিকটে হওয়া সত্ত্বেও বহু দূরে। তিনি সকলের উপরে আছেন, অথচ এটাও বলা যায় না যে, তাঁর নীচে কোন বস্তু আছে। তিনি কোন বস্তুর মতো নন। আবার তিনি কোন বস্তু হতে সৃষ্টও নন, কোন বস্তুর উপরেও তিনি নন। উপরে বর্ণিত ঐসব গুণে তিনি ব্যতীত আর কেউ গুণান্বিত নয়। কেউ একথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে চাইলে এক বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন”।



জুনায়েদের সাথে দশ হাজার খাঁটি মুরীদকে মা’রেফাতের পথে তৌহিদের দরিয়ায় ডেকে দেওয়া হলো। শেষ পযর্ন্ত আবুল কাশেম জুনায়েদ ব্যতীত আর কেউ ভেসে ওঠল না। তারপর তাঁকে ঈমানরূপ আসমানের সূরযে পরিণত করা হল। ব্যাস্‌, এতটুকুতেই যে বুঝল, বুঝে নিল ; এর বেশী ব্যাখ্যা চলে না, তাতে পথভ্রষ্ঠ হওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, যদি আমি হাজার বছর বেঁচে থাকি, তবে যতক্ষণ পযর্ন্ত আল্লাহপাক আমাকে আমল হতে ফিরিয়ে না রাখেন, ততক্ষণ পযর্ন্ত আমি নেক্‌ কাজ একটুও কম করব না। তিনি আরও বলেন, যদি নামাযের মধ্যে আমার দুনিয়ার কোন খেয়াল আসত, তখনই আমি সে নামায দ্বিতীয়বার পড়ে নিতাম। আর নামাযের মধ্যে যদি আমার জান্নাত-জাহান্নাম বা আখেরাতের স্মরণ হতো, তখন সাহু সিজদা করতাম।



একদা জুনায়েদ তাঁর মুরীদদেরকে বললেন, “যদি জানতাম যে তোমাদের সাথে বসা অপেক্ষা দুরাকাত নফল নামায পড়া উত্তম, তবে আমি কখনও তোমাদের সাথে বসতাম না”। তিনি সবসময় রোজা রাখতেন। তবে যখন তাঁর কোন বন্ধু আসতেন, তখন তিনি নফল রোজা ভঙ্গ করে তাদের সাথে খেতে বসে যেতেন এবং বলতেন, “মুসলিম ভাইদের কাজে সহযোগিতা করা নফল রোজা হতে উত্তম”। জুনায়েদ সবসময় আলেমদের মতো পোষাক পরিধান করতেন। একবার লোকেরা তাঁকে বলল, “আপনি আপনার বন্ধুদের মতো গুদরী (দরবেশী কোর্তা) পরছেন না কেন ?” তিনি বললেন, “যদি জানতাম, গুদরী ব্যবহার করলেই মকসুদ হাসিল হবে, তবে আমি লোহা এবং আগুনের গুদরীও পড়তে দ্বিধা করতাম না ; কিন্তু প্রতি মুহূর্তে প্রাণের ভেতর থেকে এই ডাক আসছে যে, খেরকায় বিশ্বাস নেই বরং আল্লাহ্ প্রেমে জ্বলে যাওয়াতেই বিশ্বাস।” 



জুনায়েদ কামালিয়াত অর্জন করলে তাঁর মোরশেদ হযরত সিররী সিকতী তাঁকে জনসম্মুখে ওয়াজ করতে বললেন। তিনি ভয়ে ওয়াজ করতে সাহস করলেন না এবং বললেন, “স্বীয় পীর সাহেব বর্তমান থাকতে মুরীদের ওয়াজ করা সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ এবং বেয়াদবী”। তারপর এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন যে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) স্বয়ং তাঁকে বলছেন যে, জুনায়েদ তুমি মানুষকে ওয়াজ-নসীহত কর। তিনি ভোর বেলায় উঠে এই খোশ্ খবর আপন পীর সররী সিকতীর কাছে প্রকাশ করতে যেতে উদ্যত হলেন। তখনই দেখলেন সররী সকতী স্বয়ং তাঁর দরজায় উপস্থিত। তিনি বললেন, “কিহে জুনায়েদ ! এখনও কি তুমি সেই পূর্বের খেয়ালে আছ ? আমরা ত বহু পূর্ব হইতেই তোমাকে ওয়াজ করতে অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছি। তুমি আমাদের কারো অনুরোধ রক্ষা করো নাই। এখন স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আদেশ করেছেন, এখন কি করবে ?” 



জুনায়েদ বললেন, “মামা, আপনি কিভাবে জানতে পারলেন যে, আমি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেছি ?” হযরত সিররী সিকতী বললেন, “আজ রাতে আমি স্বপ্নযোগে আল্লাহ্‌ পাককে এই কথা বলতে শুনলাম যে, আমি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে জুনায়েদের নিকট মিম্বরে উঠে ওয়াজ করতে হুকুম দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছি।” তাঁর কথা শুনে জুনায়েদ বললেন, “নিশ্চয়ই আমি ওয়াজ করব, তবে এ শর্তে যে, আমার মজলিশে চল্লিশ জনের বেশী শ্রোতা উপস্থিত থাকতে পারবে না”। ইহার পর একদিন তিনি ওয়াজ করেন। সেই মজলিশে কথামতো চল্লিশজন শ্রোতাই উপস্থিত ছিলেন। ওয়াজ শুনে আঠারোজন লোক সেই মাহফিলেই ইন্তেকাল করলেন। অবশিষ্ট বাইশ জন এমন বেহুঁশ হলেন যে, লোকজন এসে কাঁধে করে তাদেরকে বাড়ী নিয়ে যায়।



জুনায়েদ (রঃ) বলেন, “একবার আমার মন হারিয়ে গিয়েছিল। আমি আল্লাহ্তায়ালার কাছে আবেদন করলাম, “হে আল্লাহ, আমাকে আবার আমার মন ফিরিয়ে দাও।” তখন এ আওয়ায শুনতে পেলাম, “হে জুনায়েদ, আমি এজন্য তোমার মন নিয়ে রেখে দিয়েছি যেন তুমি আমার সাথে থাক। তুমি কি অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য আমার মন ফিরে চাচ্ছ ?” বর্ণিত আছে যে, একবার শিবলী (রহঃ) বললেন, “যদি কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে জান্নাত এবং জাহান্নাম যা ইচ্ছা গ্রহন করার জ্ন্য হুকুম করেন, তাহলে আমি জাহান্নাম গ্রহন করব। কেননা, জান্নাত গ্রহন করা আমার কাম্য, অপরদিকে এস্থলে জাহান্নাম গ্রহন করি কিনা এটা দেখাই আমার বন্ধুর (আল্লাহর) উদ্দেশ্য। সুতরাং যে বন্ধুর ইচ্ছার উপর আপন ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, তাকে প্রকৃত বন্ধু বলা উচিত নয়”। জুনায়েদ এই উক্তি শুনে বললেন, “শিবলীর এখনও বালকের চপলতা দূর হয় নি। যদি আল্লাহ্পাক আমাকে এরূপ ইখতিয়ার প্রদান করেন, তাহলে আমি (জান্নাত-জাহান্নাম) কোনটিই গ্রহন করব না। কেননা, বান্দার আবার ইচ্ছা কি ? বরং আমি বলব, “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যেখানে পাঠাও, আমি সেখানেই যাব। তোমার যা পছন্দ, আমি তাতেই সন্তুষ্ট”। 



একদিন জুনায়েদ একজন দরবেশ রোগীকে দেখতে গেলেন। গিয়ে দেখলেন যে, দরবেশ রোগের যন্ত্রণায় কাঁদছে। জুনায়েদ বললেন, “এই ক্রন্দন দিয়ে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছ”? দরবেশ চুপ করে রইলেন। জুনায়েদ বললেন, “আমার (নিজের) কাঁদারও কোন উপকরণ নাই, আবার সবর করবারও কোন শক্তি নাই।” একদিন জুনায়েদের শরীরের কিছু ব্যথা হয়েছিল। তিনি সুরায়ে ফাতেহা পাঠ করে সেখানে ফুঁক দিলেন। তখনই গায়েব থেকে কে যেন ডেকে বলল, “তোমার লজ্জা হয় না যে, আমার কালামকে তুমি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছ”? জুনায়েদ বলেছেন যে, একদিন আমার ইবলীসকে দেখার বড় আকাঙ্খা হলো। কিছুক্ষণ পর আমি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে দূর হতে একজন বৃদ্ধকে আমার দিকে আসতে দেখলাম। তাকে দেখেই আমার মনে একটু ঘৃণার ভাব হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে ?” সে উত্তরে বলল, “আমি তোমার আকাঙ্খা।” আমি বললাম, “হে মালাউন, কে তোকে হযরত আদমকে (আঃ) সিজ্দা করতে নিষেধ করেছিল ?” সে বলল, “হে জুনায়েদ ! এটা আবার আমার পক্ষে কবে বৈধ ছিল যে, আমি আল্লাহ্ তাআলা ব্যতীত অন্যকে সিজদা করব ?” জুনায়েদ বলেন, “আমি তার উত্তর শুনে হতবাক হয়ে রইলাম”। তখনই গায়েব হতে আওয়াজ এল, “হে জুনায়েদ ! তুমি শয়তানকে বল, “তুই মিথ্যা কথা বলছিস। যদি তুই আল্লাহর দাস হইতি, তাহলে কখনও আল্লাহ্ পাকের হুকুম অমান্য করতি না এবং তাঁর নিষিদ্ধ বস্তুর কাছেও যেতে না।” একথা ‍শুনা মাত্র ইবলীস চীৎকার করে বলল, “আল্লাহর কসম, তুমি আমাকে জ্বালিয়ে ছিয়েছ।” একথা বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।



একদিন জুনায়েদের কাছে এক ব্যক্তি এসে বার বার বলতে লাগল, “বর্তমানে ধার্মিক ও দ্বীনদার লোক খুবই কম এবং খোঁজ করেও পাওয়া যাচ্ছে না”। কিছুক্ষণ পর জুনায়েদ বললেন, “যদি এরূপ লোক চাও যে, সে তোমার বোঝা উঠাতে সক্ষম, তবে তা সহজে মিলবে না ! অপরদিকে যদি এমন লোক চাও যে, তুমি তার বোঝা বহন করবে, তবে আমার কাছে এমন লোক বহু আছেন”। একদিন ইবনে শুরায়হ্‌ জুনায়েদের কাছে উপস্থিত হলেন। লোকেরা চিনতে পেরে শুরায়হ্‌কে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, “আপনি জুনায়েদের উক্তিসমূহকে কেমন মনে করেন ?” তিনি বললেন, “তাঁর উক্তিসমূহ আমার অতি আশ্চরযজন বলে মনে হচ্ছে।” লোকে বলে, “আচ্ছা বলুন ত, জুনায়েদ যা বলেন তা কি তিনি নিজ ইল্‌ম বা জ্ঞান দ্বারা বলছেন ?” ইবনে শুরায়হ্ বলেন, “তা ত আমি জানি না, তবে এতটুকু বলা যেতে পারে যে, তাঁর কথা বড় তাৎপরযপূর্ণ এবং এই কথাগুলো যেন আল্লাহ্তাআলা তাঁর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন।” উল্লেখ আছে যে, একদিন শিবলী (রহঃ) মসজিদে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আল্লাহ্‌র মহত্ত অসীম”। একথা শুনে জুনায়েদ বললেন, “হে শিব্‌লী, যদি ‍আল্লাহ্‌ পাক গায়ের (অনুপস্থিত) হন, তাহলে অনুপস্থিত ব্যক্তির আলোচনা করা গীবত এবং গীবত করা হারাম। পক্ষান্তরে যদি আল্লাহ্‌ তাআলা উপস্থিত থাকেন, তবে উপস্থিত ব্যক্তির নাম নেওয়া আদবের খেলাফ বা নীতি-বিরুদ্ধ কাজ”। একদিন এক ব্যক্তি জুনায়েদের আছে জিজ্ঞেস করল, “অন্তর কখন সন্তুষ্টি লাভ করে ?” উত্তরে বললেন, “যখন এতে তিনি (আল্লাহ্‌ পাক) বিদ্যমান থাকেন।” 



জুনায়েদ বলেন, “আমি এক ক্ষৌরকারের কাছে ইখ্‌লাস বা খাঁটি আল্লাহ্‌ প্রেম শিক্ষা লাভ করেছি। আমি যখন মক্কা শরীফে ছিলাম, একজন ক্ষৌরকার এক ব্যক্তির মাথা কামাচ্ছিল। আমি ওকে বললাম, “ওহে, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমার চুলগুলো কেটে দিবে কি ?” সে বলল, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দিব” এবং সাথে সাথে তার চোখ পানিতে ভরে ওঠল। এখনও পযর্ন্ত সেই লোকটির চুল কামানো শেষ হয়নি, তথাপি সেই লোকটিকে বলল, “আপনি একটু উঠে যান। এখন আপনাকে কামাতে পারলাম না। কেননা, ইনি যখন আল্লাহ্‌ পাকের পবিত্র নাম মধ্যখানে যিক্‌র করেছেন, তখন তাঁকে আগে কামাতে হবে।” এটা বলে সে আমাকে সাদরে কাছে বসাল এবং আমার মাথা চুম্বন করে ক্ষৌরকর্ম শুরু করল। তারপর একটি কাগজের পুরিয়া আমার হাতে দিয়ে বলল, “এগুলো আপনার নিজ কাজে ব্যয় করুন”। এতে কিছু স্বর্ণ মুদ্রা ছিল। আমি তার এ উদারতা দেখে মনে মনে সংকল্প করলাম যে, যখনই আমার হাতে ধন আসবে, তখনই সর্বপ্রথম ক্ষৌরকারের এ বদান্যতার প্রতিদান দিব।



এই ঘটনার কয়েকদিন পরই বসরার জনসাধারণ আমাকে এক থলি আশ্‌রফী (সোনার মোহর) পাঠিয়ে দিল। আমি এগুলো নিয়ে ক্ষৌরকারের কাছে উপস্থিত হলাম। সে মুদ্রা দেখে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি ?” আমি বললাম, “ক্ষৌরকর্মের দিন সংকল্প করেছিলাম, আমি এরপর প্রথম যে অর্থ পার তা তোমাকে দিব।” সে আমাকে বলল, “আল্লাহ্‌র নামে কি আপনার লজ্জা হয় না যে, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমার চুলগুলো কেটে দিবে কি ? এখন আবার তার প্রতিদান কেন ? আপনি কি কাউকেও এরূপ দেখেছেন যে আল্লাহ্‌র খুশির জন্য কাজ করে আবার এর পরিবর্তে পারিশ্রমিক গ্রহন করে ?” আমি তার উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেলাম !



একবার আলী ইবনে সহল হযরত জুনায়েদকে এই বলে পত্র লিখলেন ‍ঃ “আমার অলসতার নিদ্রা এবং চিন্তাহীন ভাব অধিক, অপরদিকে প্রকৃত প্রেমিকের নিশিন্ত ভাব ও নিদ্রা বাঞ্ছনীয় নয় ; কেননা নিদ্রিত ব্যক্তির বাসনা পূর্ণ হয় না এবং সে আপনার আত্মশুদ্ধি ও অমূল্য সময় সমন্ধে অলস থেকে যায়। যেমন ‍ঃ আল্লাহ্‌ তায়ালা হযরত দাউদ (আঃ) কে ওহী পাঠিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি আমার প্রেমের দাবী করে অথচ রাত্রি এলে প্রেম ছেড়ে আরামে নিদ্রা যায়, সে মিথ্যাবাদী।” ইহার উত্তরে জুনায়েদ লিখেছেন যে, “আল্লাহ্‌র পথে আমাদের জেগে থাকাটা আমাদের ইচ্ছাধীন কাজ। আর নিদ্রা আল্লাহ্‌ পাকের কাজ এবং আমাদের প্রতি এটা তাঁর একটি মহা দান বটে। সুতরাং যে জিনিস আমাদের আয়ত্তের বাইরে এবং আল্লাহ্‌ পাক হতে প্রাপ্ত, তাকে আমাদের ইখতিয়ারাধীন বস্তু হতে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ বলে জানবে। এটা আল্লাহ্ তাআলার বন্ধুগণের উপর তাঁর করুণা।”



একদিন বাগদাদে এক চোরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো দেখে জুনায়েদ সে লাশের পা চুম্বন করেন। লোকে বলল, “একি করেন। সে যে চোর ছিল !” জুনায়েদ বলেন, “আল্লাহ্‌ পাক তার উপর হাজার রহমত নাযেল করুন। কেননা সে এক কৃতিত্বের অধিকারী। সে আপন কাজে রত থেকে মারা গেছে এবং যে কাজ আরম্ভ করেছিল তাকে শেষ সীমায় পৌঁছিয়ে ছেড়েছে।” একদিন এক ব্যক্তি এসে বলল, “আমি ক্ষুধার্ত ও বস্ত্রহীন অবস্থায় আছি।” জুনায়েদ বললেন, “যাও, নিশ্চিন্ত থাক। যে আল্লাহ্‌র নিন্দা করে আকাশ-বাতাস বিষাক্ত করে তোলে, তিনি তাকে কষ্ট দেন না ; বরং আল্লাহ্‌ তাআলা যাকে ভালবাসেন, তাকেই অন্ন-বস্ত্রে ক্লেশ দিয়ে থাকেন। তুমি তাঁর নিন্দা করো না।”



এক ধনী ব্যক্তির রীতি ছিল যে, সে কখনও সুফীদেরকে ছাড়া আর কাউকে দান করত না এবং বলত যে, “যেহেতু সুফীদের আল্লাহ্‌ পাকের যিকর ব্যতীত অন্য লক্ষ্য নাই, অভাবে পড়লে তাদের মন ও সাহস ছিন্ন হয়ে আল্লাহ্‌ তায়ালা হতে দূরে সরে যেতে পারে, সুতরাং দুনিয়াদার হাজার লোককে দান করার চাইতে তাঁদের একজনকে দান করে আল্লাহ্‌র রাস্তায় নিয়ে যাওয়া শ্রেয়।” জুনায়েদ একথা শুনে বললেন, এটা ত কোন আল্লাহ্‌ প্রেমিকের কথা বটে। অতঃপর সে দাতা অকাতরে দান করতে করতে নিঃস্ব হয়ে গেল। তখন জুনায়েদ তাকে কিছু অর্থ দান করে বলেন, “একে মূলধন করে তুমি বাণিজ্য কর। তোমার মতো লোকের পক্ষে বাণিজ্য করা অনুচিত নয়।”



জুনায়েদের একজন মুরীদ তার প্রভূত ধনসম্পত্তি পীর-সাহেবের পায়ে উৎসর্গ করেছিলেন। কেবল তার কাছে একখানা ঘর অবশিষ্ঠ ছিল। একদিন মুরীদ জুনায়েদ (পীর)কে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আমি কি করব ?” তিনি বললেন, “ঘরটি বিক্রি করে ফেল এবং ইহার মূল্য আমার নিকট নিয়ে এসো।” তিনি গিয়ে ঘরখানা বিক্রি করে টাকা নিয়ে এলেন। জুনায়েদ হুকুম করলেন, “টাকাগুলো নদীতে ফেলে দাও”। তিনি এরূপই করলেন। অবশেষে সহায়-সম্ভলহীন হয়ে তিনি পীর সাহেবের পিছু পিছু চললেন। তখন জুনায়েদ তাকে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আমার কাছ থেকে যাও- তুমি কেন আমার পিছনে পিছনে আসছ ?” তিনি যতই অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন, পীর সাহেব ততই তাকে তাড়িয়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই পিছু ছাড়লেন না। অবশেষে এভাবে পীর সাহেবের পিছু আঁকড়িয়ে ধরে থাকার ফলে সে ব্যক্তির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো, তিনি জীবনে কামালিয়াত লাভে সক্ষম হলেন।



কথিত আছে, একবার এক মুরীদের মাথায় পাগলামি খেয়াল চাপল যে, “আমি কামেল দরবেশ হয়ে গেছি। কাজেই আমার পক্ষে পীরের সঙ্গ ব্যতীত একাকী থাকাই উত্তম।” এই বলে সে নির্জনে বাস করতে লাগল। তখন তার এরূপ অবস্থা হলো যে, সে প্রত্যেক রাত্রিতে স্বপ্নে দেখত যে, ফেরেশতাগণ উট নিয়ে হাজির হয়ে তাকে বলছে, তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাব। সে সেই উটে চড়ত। উট তাকে নিয়ে যেতে যেতে এমন মনোরম স্থানে পৌঁছত যে, সেখানে দেখা যেতো বহু ‍খুবসুরত ও সুদৃশ্য লোকদের সমাবেশ। উত্তম ও উপাদেয় খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত। সম্মুখে সুপেয় পানির নদী বইছে। সে স্বপ্নের মধ্যেই সেখানে নেমে পড়ত এবং বহুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখত যে, সে নিজের ঘরেই অবস্থান করছে। তার এই খামখেয়ালী ক্রমে ক্রমে এমন পরযায়ে পৌছল যে, সে নিজেই জনসাধারণের কাছে প্রচার করতে লাগল যে, “আমি প্রতি রাতেই একবার জান্নাতে গিয়ে থাকি।” ঘটনাক্রমে এ সংবাদ জুনায়েদের কানে পৌঁছলে একদিন তিনি সেই দরবেশের কুটিরে গিয়ে দেখলেন যে, দরবেশ তার সহচরদের নিয়ে খুব শান-শওকতের সাথে বসে আছে। জুনায়েদ তার সমাচার জানতে চাইলে সে আগাগোড়া সব বর্ণনা করল। জুনায়েদ বললেন, “আচ্ছা বৎস, আজ রাতে তুমি তোমার কথিত জান্নাতে পৌঁছলে “লা হাওয়া ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ্‌” দোয়াটি অবশ্যই তিনবার পড়বে।” দরবেশ আগের মতোই ঘুমে অচেতন হলে আজ রাতেও সে কথিত বেহেশতে পৌঁছল। তখন পীর সাহেবের কথা তার স্মরণ হলে সে পরীক্ষাস্বরূপ “লা হাওলা...” দোয়াটি পড়ল। এটা শোনামাত্র উপস্থিত সকলেই প্রমোদ আসর ভেঙ্গে চীৎকার করতে করতে তাকে একাকী ফেলে যে যেদিকে পথ পেল পালাল। অতঃপর সে দেখতে পায় যে, একটি কুশ্রী ঘোড়ায় চড়ে সে এক নোংরা স্থানে উপস্থিত হয়েছে এবং সেখানে সম্মুখে মৃত জন্তুদের ‍দুর্গন্ধপূর্ণ হাড্ডি পড়ে আছে। তখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারল। ভোরে ঘুম থেকে জেগেই সে পীর সাহেবের খেদমতে হাজির হয়ে তওবা করল এবং বুঝতে পারল যে, মুরীদের পক্ষে পীরকে ছেড়ে একাকী বসবাস করা বিষতুল্য।



একবার জুনায়েদ (রহঃ) এক মজলিশে ওয়াজ করছিলেন। এক মুরীদ ‍ভাবের আতিশয্যে চীৎকার করে উঠল। জুনায়েদ তাকে নিষেধ করলেন এবং কঠোরভাবে সতর্ক করলেন, “যদি তুমি আর কখনও এরূপ চীৎকার কর, তবে তোমাকে আমার মজলিশ থেকে বের করে দিব”। তৎপর তিনি পূর্বের ওয়াজ খানি প্রথম থেকে পুণরায় শুরু করলেন। সে যুবক প্রাণপন চেষ্ঠা করল, কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারল না। ভিতরের গুমড়ানো আবেগে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সে প্রাণত্যাগ করল। এক মুরীদ জুনায়েদের সাথে কোনও একটি বিষয়ে বেআদবী করে লজ্জায় বের হয়ে যায় এবং এক মসজিদে গিয়ে অবস্থান করতে থাকে। একবার জুনায়েদ (রহঃ) সেই পথে কোথাও যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মুরীদের প্রতি তাঁর নজর পড়ে। কিন্তু হায় ! জুনায়েদের চোখে চোখ পড়া মাত্র সে ভয়ে মাটিতে পড়ে গেল এবং মাথা ফেটে কপাল বেয়ে রক্ত পড়া শুরু করল। রক্তের যে ফোটা মাটিতে পড়ছিল, তাতে অবিকল আরবীতে “আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহু” অক্ষরের আকৃতি ধারণ করছিল। জুনায়েদ (রহঃ) তা দেখে বললেন, “কি হে, তুমি কি আমাকে দেখাতে চাচ্ছ যে, তুমি মা’রিফাতের একেবারে উচ্চশ্রেণীতে পৌঁছে গেছ ? মনে রেখো, ছোট ছোট বালকেরাও (আল্লাহ্‌র) যিকরে তোমার সমান বটে ; কিন্তু পুরুষকে ত যিক্‌রের নির্ধারিত সীমা পযর্ন্ত পৌঁছা কর্তব্য”।



পীরসাহেবের কথায় তার অন্তরে এমন ভীষণ আঘাত লাগল যে, তখনই সে ধড়ফড় করে প্রাণত্যাগ করল। তারপর তাকে যথারীতি দাফন করা হলো। কিছুদিন পর এক বুযুর্গ ব্যক্তি তাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নিজেকে কোন্‌ স্তরে পেলে ?” সে উত্তরে বলল, “বহু বছর যাবত দৌড়াদৌড়ি করেছি, কিন্তু দেখি, এখনও কুফরীর সীমায় রয়ে গেছি। ধর্ম এখনও বহু দূর ! এখন বুঝেছি যে, আমার পূর্বের সমস্ত ধারণাই ভুল ছিল”। উল্লেখ আছে যে, বসরা নগরীতে জুনায়েদের একজন মুরীদ ছিলেন। তিনি নির্জনবাস করছিলেন। একদিন তাঁর অন্তরে কোনও একটি পাপ কাজের হয়ত ধারণা জন্মেছিল। তখন ‍আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে দেখেন, মুখটি কালো বর্ণ ধারণ করেছে। এতে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বহু তদবিরও করলেন কিন্তু কোন ফল হল না। এজন্য লজ্জায় কাউকেও তিনি মুখ দেখাচ্ছিলেন না। তিনি দিন পর দেখা গেলো, তাঁর অন্ধকার চেহারা ফর্সা হয়ে ক্রমে ক্রমে আসল রূপ ফুটে উঠেছে। ইতিমধ্যে একব্যক্তি এসে দরজায় টোকা দিল। তিনি ভিতর থেকে বলে উঠলেন, “কে ?” উত্তর হলো, “আমি জুনায়েদের পত্র নিয়ে এসেছি”। দরজা খুলে তিনি পত্র হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন। পত্রে লেখা ‍ঃ “বন্দেগীর পবিত্র দরবারে থাকতে কেন আদব রক্ষা করে চল না ? যদ্দরুন আমাকে তিন দিন যাবত ধোপার কাজ করতে হচ্ছে যেন তোমার কাল মুখ সাদায় পরিণত করতে পারি।”



একদিন জুনায়েদ এক মুরীদসহ ময়দানের দিকে হাঁটতে যান, সেই মুরীদের জামার এক অংশ ছেড়াঁ ছিল। সে দিন রোদ ও ছিল খুব প্রখর এবং ছেঁড়া স্থান দিয়ে রোদ তার গায়ে লাগছিল। সে গরমে অস্থির হয়ে গেল, এমনকি তার নাক দিয়ে রক্তের ফোঁটা পড়তে লাগল। তখন সে বলল, “আজ বড় গরম পড়ছে”। জুনায়েদ একথা শুনেই ক্রোধভরে তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “চলে যাও, তুমি আমাদের সঙ্গী হওয়ার উপযুক্ত নও”। তারপর তাকে আপন দল থেকে বের করে দিলেন। বর্ণিত আছে, সৈয়দ নাসেরী নামক এক ব্যক্তি হ্জ্জ করতে যাওয়ার পথে বাগদাদ নগরীতে পৌছঁলেন এবং হযরত জুনায়েদের সাথে সাক্ষাত করতে এলেন। জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে তশ্‌রীফ আনলেন ?” তিনি বললেন, “জীলান হতে।” জুনায়েদ বললেন, “আপনি কোন্‌ বংশের লোক ?” সেই ব্যক্তি উত্তরে বললেন, “আমিরুল মো’মেনীন হযরত আলী (রাঃ)এর বংশধর।” জুনায়েদ বললেন, “আপনার দাদা [অর্থাৎ আলী (রাঃ)] ত দুই তরবারি পরিচালনা করতেন, একটি নফ্‌স বা রিপুর বিরুদ্ধে, অপরটি কাফেরদের বিরুদ্ধে। আর আপনি তাঁরই বংশধর বলে পরিচয় দিলেন ; কিন্তু বলুন ত, আপনি কোন তরবারি পরিচালনা করেন ?” সৈয়দ সাহেব একথা শুনে নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন আর বললেন, “হে শেখ সাহেব, আমার হ্জ্জ এ স্থানেই ছিল। দয়া করে আমাকে আল্লাহ্‌ পাকের দিকে পথ দেখিয়ে দিন”। জুনায়েদ বললেন, “আপনার সিনা আল্লাহ্‌ পাকের খাস হারেম (পবিত্র গৃহ)। কাজেই তাতে পারতপক্ষে তাতে কোন গায়ের মাহরমকে (অযাচিত কাউকে) স্থান দিবেন না।” জুনায়েদের নসীহত শেষ না হতেই সৈয়দ সাহেব দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর উক্তিসমূহ এতই উচ্চভাব এবং গূঢ়তত্ত্বে পূর্ণ ছিল। 



বর্ণিত আছে যে, এক যুবক জুনায়েদ বাগদাদীর মুরীদদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কয়েকদিন পযর্ন্ত নামাযের সময় ছাড়া অন্য কোন সময় বিছানা থেকে মাথা উঠাতেন না। জুনায়েদ একজন মুরীদকে হুকুম করলেন যে, তাঁর পিছনে পিছনে যাও এবং তাঁকে জিজ্ঞেস কর যে, “সুফী ত সাফা বা শুদ্ধির গুণে গুণী। তবে সেই ব্যক্তি তাঁকে (আল্লাহ্‌কে) কিভাবে পাবে যে কোন গুণের অধিকারী নন ?” হুকুম মতো সে মুরীদ যুবককে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বললেন, “নিজে গুণহীন হয়ে যাও, তবেই অসীম গুণময়কে (আল্লাহ্‌কে) পাবে”। জুনায়েদ এই উত্তর শুনে একথার গুঢ়তত্ত্বে ডুবে গেলেন এবং বলতে লাগলেন, “হায়, সে ছেলেটি এমন এক নিয়ামত ছিল যার তুলনা নেই। তোমরা তাঁর উপযুক্ত সম্মান করলে না।”



একবার এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, “বান্দা কখন গোলামের হাকীকত বুঝতে সক্ষম হয় ?” উত্তরে বললেন, “যখন বান্দা প্রত্যেক বস্তুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌ পাককেই জানে, দুনিয়ার সমস্ত বস্তুর প্রকাশ একমাত্র আল্লাহ্‌ পাক হতে বলে সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখে, সকল বস্তুর অস্তিত্ব লাভ ও স্থায়িত্ব আল্লাহ্‌র হাতে এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস রাখে যে, প্রত্যেকের প্রত্যাবর্তন স্থলও একমাত্র আল্লাহ্‌ পাকের দিকেই ; তখনই তার দাসত্বের স্বরূপ প্রকাশ পায় এবং সে দাসত্বের শ্রেণীভুক্ত হয়।” লোকে সততা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তিনি উত্তরে বললেন, “সত্যবাদীর গুণের নাম সততা। সত্যবাদী ঐ ব্যক্তিকে বলে, যাকে তুমি যেরূপ গুণসমূহে গুণী বলে ‍শুনেছে, কাজের বেলায়ও সেরূপ দেখতে পাও এবং সারাজীবনই ঐরূপ দেখতে পাও। আর যে ব্যক্তিকে কথায়, কাজে ও অবস্থায় সৎ দেখতে পাও, তাকে সিদ্দিক বলিও।” লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, “এখ্‌লাস (অান্তরিকতা) কি ?” উত্তরে বললেন, “আল্লাহ্‌ পাকের কাজ করতে নফ্‌সকে (প্রবৃত্তি) করে দেওয়া ; কেননা, এটাও তোমার উপরে প্রভুত্ব করতে চায়। অর্থাৎ সমস্ত কাজ একমাত্র আল্লাহ্‌র খুশীর জন্য করা এবং তা হতে আপনার দখল না দেওয়া। কেননা, নফ্‌সের স্বভাবই হল প্রভুত্বের দাবীতে তোমাকে তার অনুগত রাখা”।



এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, “খওফ (ভয়) কি’’ ? উত্তরে বলেন, “প্রতি মুহূর্তে আযাবের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত থাকা”। জিজ্ঞেস করা হলো, “শাফ্‌কাত কি ?” উত্তরে বললেন, “কোন ব্যক্তি খাস অন্তরে কোন বস্তু চাইলে তাকে তা দান করা কিন্তু ইহার ইহ্‌সান বা প্রতিদান না চাওয়া”। জিজ্ঞেস করা হলো, “নির্জনতা অবলম্বন করা কখন কর্তব্য ?” উত্তরে বললেন, “যখন তোমার নফ্‌স হতে নির্জনতা হাসেল হয় অর্থাৎ নিজকে নফ্‌সের কবল-মুক্ত রাখতে পার”। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, “সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ও খোদাপ্রেমিক কে ?” উত্তরে বললেন, “যে দরবেশ আল্লাহ্‌র খুশীতে খুশী থাকেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ”। জিজ্ঞেস করা হলো, “কি ধরনের লোকের সাহচরযে থাকব”? উত্তরে বললেন, “যে ব্যক্তি উপকার করে তা মনে রাখে না এবং তুমি কোন অপরাধ করে ক্ষমা চাইলে তা ক্ষমা করে দেন”। জিজ্ঞেস করা হলো, “কান্নার চেয়েও উত্তম বস্তু আছে কি”? উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ, কান্নার উপরে কান্না”। জিজ্ঞেস করা হলো, “বান্দা কে ?” উত্তরে বললেন, “যে অন্যের বন্দেগী হতে মুক্ত অর্থাৎ যে অন্যের বন্দেগী করে না”। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, “মুরীদ কে ?” উত্তরে বললেন, “যে ইল্‌মের প্রহরায় থাকে এবং আল্লাহ্‌ তাআলার আশ্রয়ে থাকে, তাকে মুরীদ বলে।” লোকে জিজ্ঞেস করল, “তাওয়ায্যো (দীনতা) কি ?” উত্তরে বললেন, “মাথা নত রাখা আর মাটিতে শয়ন করা”। তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ্‌, কিয়ামতের দিন আমাকে অন্ধ করে উঠাবে ; কেননা যে তোমাকে না দেখে তার পক্ষে অন্ধ থাকাই শ্রেয়। তা হলে সে অপর কাউকেও দেখতে পাবে না”। 



যখন জুনায়েদের ওফাত (মৃত্যুক্ষণ) নিকটবর্তী হল, তখন মুরীদদেরকে হুকুম করলেন, “আমাকে ওজু করাও”। কথামতো মুরীদরা তাঁকে ওজু করাল বটে, কিন্তু ভুলক্রমে আঙ্গুল খেলাল না করায় পরে তিনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলে তারা আবার খেলাল করিয়ে দিল। তারপর তিনি সিজ্‌দায় পরে অঝোরে কাদঁতে লাগলেন। লোকেরা বলল, “হে তরীকতের সরদার ! জীবনভর এতো সিজ্‌দা, এতো ইবাদত করলেন, এখন এই শেষ মুহূর্তেও সিজ্‌দা ? এটা কি সিজ্‌দার সময় ?” উত্তরে বললেন, “যেহেতু এই সময় হতে জুনায়েদ আর কখনও অধিক মোহতাহ্‌ বা মুখাপেক্ষী হয় নি”। কিছুক্ষণ পর তিনি কোরআন শরীফ তেলাওয়াত আরম্ভ করলেন। এক মুরীদ আরয করল, “আপনি কোরআন শরীফ পড়ছেন ?” তিনি উত্তরে বললেন, “আমার পক্ষে ইহা অপেক্ষা উত্তম সময় আর কি হতে পারে ? আমার সময় খুবই কম ; অল্পক্ষণ পরেই আমার আমলনামা গুটিয়ে ফেলা হবে। আমি নিজ চক্ষে দেখছি, আমার ৭০ বছরের ইবাদত শূণ্যে একটি চুলের ন্যায় সূক্ষ্ম ডুরিতে ঝুলছে এবং একটি ঘূর্ণী বায়ু তাকে ঘুরাচ্ছে। আমি জানি না, এই বায়ু প্রবাহ কি ? তা কি মিলন ঘটাবে না বিচ্ছেদ ? আবার একদিকে নজর করলে দেখি পুলসেরাত এবং অপরদিকে মালাকুল মওত। সেই সাথে কাজীকে দেখছি, যাঁর গুণ সুবিচারময়। তিনি আমার প্রতি তাকাচ্ছেনও না। আমার সামনেই রয়েছে একাধিক পথ কিন্তু আমি জানি না তিনি আমাকে কোন্‌ পথে নিয়ে যাবেন।” 



তখন তাঁর অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ল। তিনি বিচলিত হয়ে ক্রমে মুমূর্ষ অবস্থায় পৌঁছলেন। তৎপর জুনায়েদ কোর্‌আন শরীফ খতম করলেন এবং সুরায়ে বাকারার ৭০ আয়াত পাঠ করলেন। এক ব্যক্তি বললেন, “আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ বলুন”। উত্তরে বললেন, “আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না- আমি সেই পরম বন্ধুকে ভুলিনি”। তারপর তিনি আঙ্গুলের কড়ে “সোবহানাল্লাহ্‌” পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে শাহাদাত আঙ্গুল পযর্ন্ত পৌঁছলে তা উর্ধ্বপানে তুলে ধরে বললেন, “বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহিম” এবং চক্ষু মুদিলেন। এভাবেই জুনায়েদ স্বীয় পরম মাশুকের সাথে মিলিত হলেন। গোসল দেওয়ার সময় গোসল-দাতারা তাঁর চোখে পানি ঢালতে চাইলেন। হঠাৎ গায়েবী আওয়াজ হলো, “আমার বন্ধুর চক্ষু হতে তোমাদের হাত দূরে রাখ। কেননা, আমার নাম জিক্‌র করতে করতে যে চক্ষু বন্ধ হয়েছে, সে চক্ষু আমার দর্শন ব্যতীত খুলবে না”। অতঃপর গোসলদাতাগণ তাঁর চক্ষু হতে হাত দূরে রেখেই গোসল শেষ করলেন। তারপর বাঁকা আঙ্গুলগুলো খুলতে চাইলেন বটে, কিন্তু পারল না। আওয়াজ আসল, “যে হাতের আঙ্গুল আমার নামের তাস্‌বিহ পড়তে পড়তে বন্ধ হয়েছে তা আমার হুকুম ছাড়া খুলবে না।” তারপর যখন তাঁর পবিত্র লাশের জানাযা তৈরী হল, তখন একটি সাদা কবুতর এসে জানাযার একপাশে বসে থাকল। এক ব্যক্তি এটাকে তাড়াবার যথেষ্ঠ চেষ্ঠা করল, কিন্তু কবুতর উড়ল না। সে বলে উঠল, “আমাকে তোমরা কষ্ঠ দিও না- নিজেরাও বৃথা কষ্ঠ করো না। কেননা, আমার নিম্নভাগ তো কোন প্রেম-প্যারেকে খাটের সাথে আবদ্ধ। আর ‍আজ তোমাদের জানাযা উঠানোর কষ্ঠ স্বীকার করতে হবে না। কেননা, আজ হযরত জুনায়েদের লাশ ফেরেশতাদের ভাগে পড়েছে। তোমরা এখানে গন্ডগোল না করলে এই পবিত্র লাশ বাজপাখীর আকারে আকাশে উড়ত।”



হযরত জুনায়েদের ওফাতের পর এক ব্যক্তি তাঁকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি মোনকার-নাকীর ফেরেশতাদের সওয়ালের কি জওয়াব দিয়েছেন ?” উত্তরে বললেন, “যখন সেই দুই ফেরেশতা আল্লাহ্‌ জাল্লা জালালুহুর দরবার হতে জাঁকজমকের সাথে আমার কাছে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার প্রভু কে ?” আমি ঈষৎ হেসে বললাম, “যখন সে মহাপ্রভু প্রশ্ন করেছিলেন (আমি কি তোমাদের প্রভু নই ?) তখনই ত আমি জওয়াব দিয়েছিলাম (হ্যাঁ) ; এখন তুমি আবার এসেছ প্রশ্ন করতে যে, “তোমার প্রভু কে ?” যে বাদ্‌শার সওয়ালের জওয়াব দিয়েছে, তাঁর আবার গোলামের জওয়াব দিতে ভয় কি ? যাক শোন, আমি আজ প্রভুর ভাষাতেই ইহার জওয়াব দিচ্ছি, “প্রভু ঐজন, যিনি আমাকে সৃষ্ঠি করেছেন, পরে তিনি আমাকে জীবন-পথে নিয়ে থাকেন”। ফেরেশতাদ্বয় উত্তর শুনে সসম্ভ্রমে উঠে পরস্পর এ বলতে বলতে চলে গেলেন যে, “ইনি ইশ্‌কের নেশায় এখনও মস্‌ত হয়ে আছেন”। হযরত হারীরী (রহঃ) বলেন, “আমি জুনায়েদ (রহঃ) কে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “আল্লাহ্‌ পাক আপনার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন ?” তিনি উত্তরে বললেন, “রহম করেছেন এবং মা’ফ করে দিয়েছেন। আর সেই দুই রাকাত নামায, যা মধ্যরাত্রিতে নিয়মিত পড়ার আমার অভ্যাস ছিল, তা ছাড়া আর কোন কিছুই আমার কাজে আসেনি”।



অমিয় বাণী

১। সাধনার পথে অনেক ডাকাত ওৎপেতে আছে। তারা এই পথে নানা প্রকারের জাল বিস্তার করে রাখে। ধোঁকার জাল, মোহের জাল, শক্তির জাল, অনুগ্রহের জাল ইত্যাদি এমন অসংখ্য জাল রয়েছে, যার ইয়ত্তা নাই। কাজেই এই পথের পথিককে এমন বীরপুরুষ হতে হবে যেন বিভিন্ন জালের ভিতরের প্রভেদ বুঝতে পারে।

২। সাধক আল্লাহ্‌ প্রেমে অস্থির হয়ে যে আক্ষেপের সুদীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন, তা মানুষ ও আল্লাহ্‌র মধ্যকার পরদাসমূহ জ্বালিয়ে দেয়।

৩। যে ব্যক্তি জীবনে একবারও নিজের অন্তরে আল্লাহ্‌ পাককে পেয়েছে, সে-ই প্রকৃত সুখী।

৪। আল্লাহ্‌পাক তাঁর বান্দাকে দুই ইল্‌মে (জ্ঞানে) আলেম দেখতে চান ‍ঃ (১) অবুবিয়াত বা দাসত্ব জ্ঞানের ইল্‌ম ; (২) রবুবিয়াত বা আল্লাহ্‌তত্ত্ব জ্ঞানের ইল্‌ম। অন্যান্য ইল্‌ম দুনিয়ার সুখ-ভোগের উদ্দেশ্যের মধ্যে গণ্য।

৫। তৌহিদের (একত্ববাদের) ময়দানে চিন্তায় বিভোর থাকাই আল্লাহ্‌ পাকের সাথে শ্রেষ্ঠতম সম্পর্ক।

৬। হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) যে-পথ দেখিয়ে গিয়েছেন, তাই চলার পথ। এ পথ ছাড়া মানুষের পক্ষে অন্য সমস্ত পথ নিষিদ্ধ।

৭। যে ব্যক্তি পাক কোরআনের নির্দেশ মানে না এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর শিক্ষা জানে না, কখনও তোমরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেননা, এই ব্যক্তি অজ্ঞ। কারণ, জ্ঞান কেবলমাত্র কোরআন ও হাদীসের ভেতরেই সীমাবদ্ধ।

৮। মানুষ সৎস্বভাবের দ্বারা হয়, আকৃতি দ্বারা নয়।

৯। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ পাককে অপরিজ্ঞাত বলে, সে মিথ্যুক।

১০। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ পাককে চিনতে পারে না, সে কখনও সুখী হতে পারে না।

১১। যতদূর সম্ভব চেষ্ঠা করবে যেন তোমার ঘরের সমস্ত মালপত্র মাটির তৈরী হয়।

১২। সে-ই প্রকৃত বান্দা যে খিদমতে ত্রুটি না করে, কোন বিষয়ে অভিযোগ না করে এবং ভাই-বন্ধু এলে তাদের সামনে নফল ইবাদত বন্ধ রাখে।

১৩। আমি সত্য বলছি, আল্লাহ্‌ তাআলা আপন বান্দার সাথে আখিরাতে সেরূপ ব্যবহার করবেন, বান্দা পূর্বাহ্নে যেরূপ করে যাবে।

১৪। আল্লাহ্‌ তাআলা আপন বান্দাকে যত কাছে দেখেন, ততই নিজে তার অন্তরের নিকটবর্তী হন।

১৫। আলেমদের সমস্ত বিদ্যা দুই শব্দে নিবদ্ধ ‍ঃ (১) জাতির সংশোধন (২) খাঁটি জনসেবা।

১৬। যার জীবন শ্বাসের উপরে নির্ভর করে, তার শ্বাস বের হয়ে গেলেই মৃত্যু। আর যার জীবন আল্লাহ্‌ তাআলায় আবদ্ধ, তার মৃত্যু হইল স্বাভাবিক জীবন হতে প্রকৃত জীবনের দিকে ফিরে যাওয়া এবং এটাই আসল হায়াত বা অনন্ত জীবন।

১৭। যে চক্ষু আল্লাহ্‌ পাকের সৃষ্ঠবস্তুকে শিক্ষণীয় বিষয়রূপে না দেখে, তার পক্ষে অন্ধ হওয়াই শ্রেয়। যে জিহ্বা আল্লাহ্‌ তাআলার জিক্‌র করে না, তার বোবা হওয়াই শ্রেয়। যে কান আল্লাহ্‌ পাকের সত্য কালাম শুনতে অভ্যস্ত নয়, তার বধির হওয়াই শ্রেয়। যে শরীর প্রতিপালকের ইবাদতে কোন কাজে লাগে না, তার মৃত্যুই শ্রেয়।

১৮। পীরের কাছে মুরীদের প্রথমে নামাযের বিষয়সমূহ ছাড়া অন্য কিছুই শিক্ষা করা উচিত নয় ; এজন্য ভালোরূপে সুরায়ে ইখলাস এবং সুরায়ে ফাতিহা শেখাই যথেষ্ঠ।

১৯। যে ব্যক্তি খাবার খাওয়ার ভাণ্ড সামনে রেখেছে, সে মোনাজাতের স্বাদ কখনও পেতে পারে না।

২০। তোমরা দরবেশ সাজিয়াছ এবং এজন্য লোকেরাও তোমাদের সম্মান করে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ, আল্লাহ্‌ পাকের সাথে নির্জনে তোমাদের সম্পর্ক কিরূপ !

২১। যারা নেক্‌ কাজে সাহসী এবং অটল, তারাই চক্ষুষ্মান। আর যাদের কেবল ইচ্ছা আছে কিন্তু কাজের সাহস নেই, তারা অন্ধ।

২২। যখনই তুমি নিজ অন্তরকে খোঁজ করবে, তখনই তাকে আল্লাহ্‌ পাকের দাসরূপে পাবে।

২৩। সাধক যখন আল্লাহ্‌ পাকের ইশ্‌কে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন সে দিনে হাজার বারও মরতে প্রস্তুত হয়।

২৪। নবীগণের উক্তি আল্লাহ্‌ তাআলার প্রত্যক্ষ সংবাদ আর সিদ্দিকগণের উক্তি আল্লাহ্‌ পাকের নূর দর্শনের আভাস মাত্র।

২৫। সুফীরা জমীনের মত ; সকল আবর্জনা তার উপরই ফেলা হয়। আবার ইহার ভেতর হতেই সকল সতেজ ও শস্য-শ্যামলা উদ্ভিদরাজি উৎপন্ন হয়ে থাকে।

২৬। আল্লাহ্‌ পাকের জিক্‌রের সমষ্ঠি, তাঁর হুকুম মান্য করার প্রেরণা ও পায়রবী দ্বারা তা আমল করাকেই তাসাওফ বলে।

২৭। তাসাউওফ শব্দ ‘এসতেফা’ হতে উৎপন্ন যার অর্থ বাছাই করা এবং পবিত্র। অতএব যে ব্যক্তি এক আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কারও স্মরণ হতে পবিত্র, তাকেই সুফী বলে।

২৮। সমস্ত সম্পর্ককে ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহ্‌পাকের মধ্যে নিজকে ডুবিয়ে দেয়ার নামই তাসাউওফ বা তরীকত।

২৯। এক আল্লাহ্‌র জিকির করতে করতে বিভোর হয়ে অন্য কোন দিকে মন না দিয়ে আল্লাহ্‌র যিক্‌রে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নামই তরীকত।

৩০। মা’রিফাত দুই প্রকার ; যথা ‍ঃ- (১) মা’রিফাতে তাসাউওফ অর্থাৎ মানুষের নিজের ইচ্ছায় আল্লাহ্‌ পাকের সাথে প্রেম করা ; আর (২) মা’রিফাতে আয়ার্‌রুফ অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাকের নিজের ইচ্ছায় মানুষের সাথে প্রেম করা।

৩১। ইল্‌ম ও মা’রিফাত উভয়ই মুহীত (সীমাবদ্ধ) বস্তু। ইল্‌ম (জ্ঞান) আল্লাহ্‌ পাককে চেনার জন্য এবং মা’রিফাত বান্দার নিজকে চেনার জন্য। উভয়টিই সীমাবদ্ধ ; তাই যখন এই সীমাবদ্ধ ইল্‌ম এই সীমাবদ্ধ মা’রিফাতে ডুবে যায়, তখন আর পরস্পরের শির্‌ক (অংশীবাদ) থাকে না।

৩২। ইশ্‌ক আল্লাহ্‌ পাকের একটি আমানত মাত্র। যে ইশ্‌ক গরযের (স্বার্থ) জন্য হয়, গরয হাসিল হলে আর সে ইশ্‌ক থাকে না।

৩৩। মানুষ যে পযর্ন্ত আল্লাহ্‌ তাআলার পথে জান কুরবান না করে, সে পযর্ন্ত আল্লাহ্‌ পাকের মহব্বত হাসিল করা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। লোকে জিজ্ঞেস করল, “মোরাকাবা এবং লাজ্জাত-এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ কি ?” উত্তরে বললেন, “মোরাকাবা হলো গায়েবী বস্তু পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করা আর লাজ্জাত হলো উপস্থিত ক্ষেত্রে শরম দেখানো।”

৩৪। অবুদিয়াত (দাসত্ব) দুটি স্বভাবের মধ্যে পাওয়া যায় ‍ঃ (১) ভিতরে বাহিরে আল্লাহ্‌ পাকের সাথে সততা রক্ষা করা (২) সব কাজে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুসরণ করা।

৩৫। স্বাদে তৃপ্তি এবং চেষ্ঠায় বিশ্বাস- এই দুটিকে ত্যাগ করতে পারলেই দাসত্বের হক আদায় হবে।

৩৬। নিজেকে নেয়ামতের উপযুক্ত বলে ধারণা না করাই শোক্‌র। 

৩৭। যে স্থলে মিথ্যা না বললে রক্ষা পাওয়া যাবে না, সেই স্থলেও যিনি সত্য বলেন, তাঁরই প্রকৃত সত্যনিষ্ঠা আছে।

৩৮। সত্যকে খুজেঁ পায় নি, এমন লোক দুনিয়ায় নেই।

৩৯। খাঁটি ফকীরের চিহ্ন এই যে, কাউকেও প্রশ্ন করবে না এবং কারও সাথে ঝগড়া করবে না। কেউ ঝগড়া করলেও চুপ করে থাকবে।

৪০। সবরের (ধৈর্‌যের) শেষ পযার্য়ই হলো তাওয়াক্কোল (আল্লাহ্‌র ওপর ভরসা)। আল্লাহ্‌র প্রতি সব কাজে নিরর্ভরতার দ্বারাই ধৈর্‌য পূর্ণতা পায়।

৪১। সবর (ধৈর্‌য) মানুষকে বিনা প্রার্থনায় এবং বিনা মিনতিতে আল্লাহ্‌ পাকের সাথে সবর্দা লিপ্ত রাখে।

৪২। তিক্ত জিনিস আহার করে মুখ বিকৃত না করার নামই সবর এবং না খেয়েও খাওয়ার মতো ভাব দেখানোকেই বলে তাওয়াক্কোল।

৪৩। রোযগার না করার নাম তাওয়াক্কোল নয় বরং আল্লাহ্‌ তাআলার ওয়াদায় মনে সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখার নামই তাওয়াক্কোল।

৪৪। উভয় জাহানের কারও চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ না জানা এবং একমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলা ছাড়া অপর কারও মুখাপেক্ষী না হওয়াই ‘তাওয়ায্যো’ (নম্রতা)।

৪৫। চারিটি বস্তুর নাম সৎস্বভাব ‍ঃ- (১) ছাখাওয়াত (বদান্যতা) (২) মহব্বত (৩) নসীহত ও (৪) অনুগ্রহ।

৪৬। আল্লাহ্‌ পাকের নেয়ামত (অনুগ্রহ) এবং তৎসঙ্গে নিজ অপরাধের কথা চিন্তা করলে যে অবস্থা হয়, তাই হায়া বা লজ্জা।

৪৭। আপন এখতিয়ারকে (ইচ্ছা) ভুল করে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার ওপর নিজকে ছেড়ে দেওয়ার নাম রেযা (সন্তুষ্টি)।

৪৮। তওবার তিন অবস্থা ‍ঃ (১) আল্লাহ্‌ পাকের কাছে লজ্জিত হওয়া, (২) গুণাহ পরিত্যাগ করার দৃঢ় সংকল্প করা, (৩) নিজেকে জুলুম এবং ঝগড়া থেকে বিরত রাখা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Write a letter to your friends inviting him to your sister’s marriage ceremony

বাংলা বানানে ‘ই-কার‘ এবং ‘ঈ-কার’ এর নিয়ম

বাংলায় মধ্য-অ এর উচ্চারণ