না বলা কথা
না বলা কথা
প্রেসির দেখা যে আবার পাবো এমনটা কল্পনাও করিনি!কাল ওর সাথে আবারও দেখা হলো। স্বপ্নে!স্বপ্ন হলেও যেন সত্য। ওর সাখে দেখা হয়েছে পুরোনো দিনের মতই।যখন ও চলে যাচ্ছিল তখন বেদনায় বুকটা ঘুমের মধ্যেও যে শূন্য হয়ে যাচ্ছিল তা আমি অনুভব করেছিলাম।
ওর আসল নাম প্রেসি তবে আমি ওকে পারু নাম দিয়েছিলাম।আমার সবচেয়ে প্রিয় নাম এটি।আমি নিজেও জনসমাজে পার্বতী পারু নামে পরিচিত।গত বর্ষায় প্রেসির সাথে আমার প্রথম দেখা।শুরুতেই মস্তবড় ভুল করে বসলাম।পেছন থেকে দেখেই আমার বন্ধু আসু মনেকরে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিলাম প্রেসির পিঠে।যখন দেখলাম নাক চ্যাপ্টা মেমে সাহেব,এটা আসু নয় তখন পালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না।আমাদের দেশের বাঙালী বাবুরা ততক্ষণে আমায় ঘিরে ফেলেছে।এখন শুধু অনুমতির পালা।প্রেসি অনুমতি দিলেই বাবুরা আমাকে আলুভর্তা করে ফেলবে।কিন্তু ঘটনা হলো অন্যরকম।প্রেসি নিজেই আমাকে রক্ষা করলো।
”Don’t Worry. It’s not a problem.
Please leave him.
প্রেসির মুখে ইংরেজি শুনে বুঝতে পারলাম সে খোদ ইংরেজ।তাহলে নাক চ্যাপ্টা কেন?অদ্ভুত প্রশ্ন!মানুষের নাক চ্যাপ্টা থাকতেই পারে।তবে প্রেসির ব্যাপারটা ভিন্ন।তার এই চ্যাপ্টা নাকই তাকে অধিক সুদর্শন করেছে।আপন মনে চিন্তা করছিলাম।হঠাৎ শুনতে পেলাম-
-Hi! I am Precee from Korea
আমি হাসি মুখে বললাম যে আমি বাঙালী।আমার কথা শুনে প্রেসি একটুও চমকালোনা।কেননা বাংলাদেশে বাঙালী থাকবে এটাই স্বাভাবিক।সুতরাং আমি যে বাঙালী সেটা সেও বুঝতে পেরেছিলো।আমরা অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম।প্রেসি আসলে বড় হয়েছে ইংল্যাণ্ডে।আর মাতৃভূমি কোরিয়া।বাংলাদেশে এসেছে ভ্রমণ করতে, বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে। শুরুতেই ইচ্ছা ছিল একজন দোভাষী যোগাড় করে নিবে কিন্তু পরে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে।সে বাংলাদেশে নতুন একটা সংযোগ চালু করেছে। “আমাদের ফোন” কোম্পানির।বক্তচোষা বাদুড় আর এই কোম্পানির মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
প্রেসি তার ফোন নম্বরটা আমাকেও দিয়েছে।একদিন খুব সকালে সে আমাকে ফোন করে বললো-
-Parbati, Where are you now?
-Home. And taking rest.
-Please come to my Hotel Quickly
হোটেলের ঠিকানা ও রুম নম্বর আগেই বলেছিল।আমি চলে গেলাম।গিয়ে দেখলাম ঘটনা সামান্য।ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।সে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে।নারী জাতি বড়ই আশ্চর্য জনক।কথা আর
কাজের মাঝে কোন মিল পেলাম না।ঘুরতে বের হয়ে গেলাম।প্রথমেই
আহসান মঞ্জিল তারপর লালবাগ কেল্লা।আমি ফটোগ্রাফার
এর দায়িত্ব পালন করছি।মাঝে মধ্যে প্রেসির বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর
দিচ্ছি।দুপুরের খাওয়ার সময় হলো লালবাগ কেল্লায়।তার সামনেই
একটি রেস্টুরেন্টে আমরা লাল কাচ্চি বিরিয়ানি খেলাম।
প্রেসি খুব মজার
মানুষ।সে এক এক সময় এমন এমন কথা বলে, না হেসে উপায় নেই।অতি সহজেই তার সাথে
আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
পরদিন আমরা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে বের হলাম।প্রাচ্যের অক্সফোর্ড
খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের প্রথম এবং বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়।ব্রিটিশ
আমলে ১৯২১ সালে এটি তৈরি।এটি ছিল সন্ধ্যা।টি.এস.সি, কলা ভবন, কার্জন হল দেখার পর শহীদ মিনার এবং অবশেষে আমরা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মাঠে
বসে অনেকক্ষণ গল্প করলাম।প্রেসির আসল উদ্দেশ্য
আমি তখনও বুঝতে পারিনি।তবে লক্ষ্য করেছি সে কিছু কিছু যায়গায় একা কিছু লোকের সাথে দখা করে।আমাকে সেখানে
নেয় না।
যাইহোক পরদিন ছিলো
একটা চমৎকার দিন।আমাদের চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবার কথা
ছিল। কিন্তু হলো না।প্রেসি
অসুস্থ।ঠাণ্ডা জ্বরে সে কাত।আমাকে ফোন
করেছিল।আমি নয়মিত জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল নিয়ে হাজির হলাম। এই ওষুধের
একটা চমৎকার গুন আছে।খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে জ্বর নেমে যায়।সাময়িক
ভালো লাগে।প্রেসির শরীর থেকেও জ্বর নেমে গেলো।সে আমাকে
অবাক করে বললো
-কেমন আছ পার্বতী?
পার্বতী পারু আমারই
নাম।যদিও এটা মেয়েদের নাম এবং আমি মেয়ে নই।তবুও আমি
পার্বতী পারু।যাইহোক প্রেসির মুখে বাংলা শুনে আমি বিস্মিত হলাম এবং
বললাম
-তুমি বাংলা জানো?
সে হ্যা সুচক মাথা
নাড়লো।সে দিন দিন আমার প্রতি দূর্বল হতে শুরু করেছে।মানুষ যখন
কারও প্রতি দূর্বল হতে শুরু করে, তখন তাকে নিজের অনেক গোপন কথাও বলে দেয়।আজ আরও
একটি নতুন খবর শুনলাম। প্রেসি ভ্রমনের
জন্য নয় বরং বসের ব্যবসায়ের কাজে বাংলাদেশ এসেছে।এবং প্রায়ই
সে বাংলাদেশে আসে।বাংলা ভাষাটাও তার জানা।আমি বললাম
-আলহামদুলিল্লাহ! তাহলেতো কথাই নেই।বাংলায়
মনের ভাব প্রকাশ করতে পারব।
-সে বলে উঠল, “শখ কত………………………!!”
-আমি বললাম এই শোন তোমকে মেম সাহেবদের মতো প্রেসি বলে ডাকতে পারব না,তুমি পারু।আমি তোমাকে পারু
বলেই ডাকব।
-সে তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই বলে ডেকো।
পারুর প্রতি দূর্বলতা
আমার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।তার চ্যাপ্টা নাক
আমার সবথেকে বেশী ভালো লাগে। বুঝতে পারছি
তারপ্রতি আমার ভালবাসা জন্মাচ্ছে।কিন্তু উপায় কি? দুইজন দুই মেরুর।এসব প্রেম টেম আমার
দ্বারা সম্ভব না।ভাবছিলাম,
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল
-হ্যালো পারু?তুমি কোথায়?
-ট্রেনে,চিটাগাং যাচ্ছি।
-আমাকে জানালে না কেন।আমিও যেতাম।
-তোমার আসার দরকার নেই।বস হঠাৎ ফোন করে
জরুরী যেতে বললেন তাই চলে এলাম।আমি আগামী কালকের
ফ্লাইটে ইংল্যাণ্ড চলে যাব।আজই চিটাগাং থেকে
ফিরব।তুমি আমার সাথে দেখা করো।অবশ্যই
করবে কিন্তু।
-আচ্ছা করবো।আমি সামান্য কষ্ট
পেলাম।কিন্তু তার বস এত জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরার জন্য তলব
করল কেন?
প্রেসির জন্য হোটেলে
বসে আছি।কখন আসবে।সময় যেন কাটছে না।ওই দিন
প্রেসি এলো না।আমিও বাসায় ফিরেছি।এই মুহুর্তে
ফোন এল
-হ্যালো কে বলছেন?
-আমি বিমান বন্দর থানার ওসি হারুন-অর-রশীদ।
-জ্বী রশিদ ভাই বলেন।
-আপনি কি প্রেসিলিয়ান ইনগ্রা কে চিনেন?
-জ্বী না। আমি প্রেসিকে চিনি।ইল্যাণ্ড
থেকে এসেছে।জন্ম কোরিয়া।
-আপনার মত সহজ-সরল লোকদের পটানাই এদের কাজ।
-কেন প্রেসি কি করেছে?
-সে একজন স্মাগলার।অবৈধ মাদক চোরাচালানের
সাথে সে জড়িত।
আমি একটুও অবাক
হলাম না।প্রেসি আর যাই হোক আমার সাথে কোন রকম দূর্ব্যবহার করেনি।
-স্যার উনাকে এখন কোথায় রেখেছেন?
-এয়ারপোর্টে। প্রাথমিক
ক্যালনি শেষ,এখন নিজ দেশে পাঠানোর আইনি ব্যবস্থা হচ্ছে।ওখানে গিয়ে
মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক দুটোই হবে।
দেরি না করে এয়ার
পোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।জিয়া আন্তর্জাতিক
বিমান বন্দর।বর্তমানে নামে পরিবর্তন আনা হয়েছে।আমদের দেশে
ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল্যবান স্থাপনারও নামের পরিবর্তন হয়।যাইহোক
বিমানবন্দরের বর্তমান নাম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।পারুর সাথে
দেখা করতেই সকলের সন্দেহের তীর আমার দিকে।পারুর হাত দুটো
বাঁধা।নাকে রক্ত জমাট বেধে গেছে।আমাকে দেখেই
চোখ ছলছল হয়ে গেল তার।মনে মনে হয়তো কিছু বলতে চাইছিল।আমি কোন
কথা না বলেই ফিরে আসছিলাম। মনেমনে
হয়ত সবথেকে কাছের মানুষটাকেই ফেলে আসছিলাম। কিন্তু
কি আর করা। হঠাৎ সে আমাকে পেছন থেকে ডাক দিলো।
-পার্বতী………… “তাঙাশিনুল সারাঙ হা ইয়ো” Really It has no fault.
আমি তার দিকে তাকালাম, দু’চোখের জল বেয়ে পড়ছে।
-আমি বললাম কি?
-সে উত্তর দিল কিছু না।
আজ আমি তার “তাঙাশিনুল সারঙ হা ইয়ো”-এর অর্থ বের করতে পেরেছি।শুধু আর দেখা পাইনি তার।না বলা কথা বলার সুযোগ আর আসেনি আমার……………………!!
মন্তব্যসমূহ