জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ
জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ
জঙ্গিবাদ বর্তমান বিশ্বের প্রধান সমস্যা। আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে কোনো না কোনোভাবে জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হয়েছে। এ তালিকায় আছে বাংলাদেশও।
জঙ্গিবাদ কি
জঙ্গিবাদ বলতে বর্তমানে ‘অস্ত্রধারী ধর্মগোষ্ঠী’কে বোঝানো হয়। যারা কিনা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ধর্মীয় বিধান প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যদিও জঙ্গ অর্থ হচ্ছে ‘যুদ্ধ’। সে অনুযায়ী জঙ্গি মানে সৈনিক। বাংলায় একে ‘বাদ’ তথা মতবাদ বলা হলেও বাস্তবে এর কোনো সুগঠিত তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। মৌলবাদের মতো কোনো সুস্থির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইংরেজিতে এটি বুঝাতে ‘মিলিট্যান্ট’ বা ‘মিলিট্যান্ট এক্সট্রিমিজিম’ ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে ধর্মগোষ্ঠীর গোপন হানাহানির অনেক আখ্যান চালু থাকলেও সেসব ধর্মগোষ্ঠীকে জঙ্গি বলা বা বোঝানো হতো না। কারণ এখনকার সময়ে অধিকাংশ দেশে সাধারণের অস্ত্রধারণ যেমন বেআইনি, ইতিহাসে সবসময় তেমন ছিল না। ফলে এখন অস্ত্রধারী হলেই যেভাবে দেখা হয়, অতীতে তেমনটা ভাবার কোনো কারণ ছিল না।
ইতিহাস
প্রথম সুসংগঠিত জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পায় ইহুদিদের সংগঠন হাগানাহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত কাল পরেই বেশ কিছু ইহুদিবাদী জঙ্গি সংগঠন বিকশিত হয়। এর মধ্যে হাগানাহ ছিল বড়। আরও ছিল সন্ত্রাসবাদী ইহুদি সংগঠন ইরগুন এবং স্টার্ন গ্যাং। ইরগুন নেতা ছিলেন উন্মাদ আরববিরোধী মোনাচেম বেগিন, যিনি পরবর্তীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। স্টার্ন গ্যাং-এরও নেতা ছিলেন ইসরাইলের ভাবী প্রধানমন্ত্রী কুখ্যাত ইজ্যাক সামির। সশস্ত্র কমান্ডো দল প্যালম্যাকের নেতা ছিলেন আর এক ভাবী প্রধানমন্ত্রী জঘন্য বর্ণবাদী ইজ্যাক রবীন এবং যুদ্ধোন্মাদ মোশে দায়ান। এদের সমন্বয়ে জায়নবাদীরা তখন ৫০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী গড়ে তোলে। অল্পদিনের মধ্যেই তা ৮০ হাজারে উন্নীত করা হয়। স্থলবাহিনী ছাড়াও জায়নবাদীদের ছিল ছোট আকারের একটি বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী, ছিল ট্যাঙ্ক বহর, সাঁজোয়া যান ও ভারী কামান। এই বাহিনীর কাজ ছিল ফিলিস্তিনি-আরবদের তাদের মাতৃভূমি থেকে জাতিগতভাবে মুছে ফেলে সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।পরবর্তীতে জঙ্গি গোষ্টী হিসেবে আলকায়েদা, বোকোহারাম, আই এস এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য।
জঙ্গিবিরাধী অভিজান ও বাংলাদেশ
জঙ্গি বিরোধী সফল অভিযানের কারনে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।সম্প্রতি সময়ে পরিচালিত কয়েকটি অভিযান হলো-
অপারেশন থান্ডারবোল্ট
গুলশানে জঙ্গি দমনে ও জিম্মি ঘটনা অবসানের জন্য পরিচালনা করা হয় থান্ডার বোল্ট অপারেশন। অভিযানে অংশ নেয় সামরিক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চার সহস্রাধিক সদস্য। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। মাত্র ১২-১৩ মিনিটের এ অভিযান পরিচালিত হয়। থান্ডার বোল্ট অভিযানের তত্ত্বাবধান করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহম্মদ সফিউল হক। আরও ছিলেন নৌবাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক ও অন্যান্য সংস্থার প্রধানরা। কমান্ডো অভিযানে ৬ জঙ্গি নিহত হয়।
এ হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই ঈদুল ফিতরের দিন সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলা এবং গোলাগুলিতে দুই কনস্টেবলসহ চারজন নিহত হন। হামলার দিনই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় আবীর রহমান নামে নব্য জেএমবির এক সদস্য। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় শফিউল নামে আরেক জঙ্গি।এরপর নড়েচড়ে বসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান। জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড, অস্ত্রদাতা, অর্থদাতা, প্রশিক্ষণ-প্রশিক্ষক ও জঙ্গিদের আশ্রয়দাতাদের শনাক্ত করা হয়। তদন্তে উঠে আসে নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়ানো উগ্রপন্থী সংগঠন নব্য জেএমবি। পরে ৫ আগস্ট র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শফিউল ও তার সহযোগী আবু মোকাতিল নামে দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়।
অপারেশন স্টর্ম-২৬
২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের একটি জঙ্গি আস্তানার সংবাদ পায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখানে চলে ‘অপারেশন স্টোর্ম’। এতে নিহত হয় ৯ জঙ্গি। নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় জানা যায়নি।
অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭
২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ওই অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবি নেতা ও গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরী। এ সময় তামিমের সঙ্গে মারা যায় তার আরও দুই সহযোগী।
অপারেশন স্পেইট-৮
৮ অক্টোবর ২০১৬ পুলিশ ও র্যাব গাজীপুর, আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলের চার আস্তানায় অভিযান চালায়। গাজীপুরে পৃথক দুই অভিযানে ৯ জঙ্গি, টাঙ্গাইলে দুই জঙ্গি এবং আশুলিয়ায় নিহত হয় জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা।
অপারেশন রিপল-২৪
২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় প্রায় ১২ ঘণ্টার পুলিশি অভিযানে জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুজন নিহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় এক শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করে নিহত আরেক জঙ্গিনেতা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রীসহ চারজন। সমাপ্তি শেষে অভিযানটির নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন রিপল-২৪’। ওই বাড়িতে ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে’ নিহত দুজনের একজন হলেন জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলে আফিফ কাদেরী আদর (১৪)। নিহত অন্যজন জঙ্গিনেতা সুমনের স্ত্রী শাকিরা।
অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬
১৬ মার্চ ২০১৭ প্রথম জঙ্গি আস্তানায় এ ধরনের প্রথম অভিযান পরিচালনা করলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চট্রগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৫ মার্চ সন্ধান পাওয়া এ আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করা হয় ১৬ মার্চ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে। অভিযানে নিহত হয় ৪ জঙ্গি। আস্তানায় আটকে পড়া ১৮ জনকে নিরাপদে বের করে আনে অভিযানে অংশ নেয়া সোয়াতের সদস্যরা।
অপরেশন টোয়লাইট
এই অভিযানটিতে জঙ্গী দমনে সেনাবাহিনী সময় নেয় টানা ১১১ ঘণ্টা(২৫-২৮ মার্চ)এই অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা তাদের জীবন বাঁজি রেখে ২৫ মার্চ দুপুরে অত্যন্ত দক্ষতার সহিত পাঁচ তলা বাড়িটির প্রতি তলায় ৬টি করে মোট ৩০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৮টি ফ্ল্যাটে বসবাসকারী ৭৮ জন জিম্মিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে যাদের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ শিশু ছিলো।অপারেশন টোয়ালাইট’এ নিহত জঙ্গির সংখ্যা চার।২৫ মার্চ ২০১৭ সালে আতিয়া মহল থেকে ২০০ গজ দূরে আতিয়া মহলের বাইরের জঙ্গীদের বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন। এছাড়া আহত হন র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ ৪৪ জন।
অপরেশন ম্যাক্সিমাস
৩১মার্চ-১ এপ্রিল মৌলভিবাজারের রড়হাটে জঙ্গি আস্তানায় সোয়াত কর্তৃক পরিচালিত অভিযান অপরেশন ম্যাক্সিমাস।এতে তিন জঙ্গি নিহত হয়।
এক নজরে জঙ্গি বিরোধী
অভিযান
মন্তব্যসমূহ