বিবাহ


বিবাহ (৩১.০৮.২০১৩)

বাড়িতে পা রাখিবার তিল পরিমান জায়গা নাই।মাঝে মধ্যে দুই চারিজন লোক আসিতেছেন আবার চলিয়া যাইতেছেন।সর্বক্ষনের জন্য ফাঁকা হইতেছে না।বাড়ির কর্তা মিলান মিয়ার হাফ ছাড়িবারও সময় নাই।একবার তিনি নিমন্ত্রনের কাগজখানা হাতে লইয়া দেখিতেছেন কেউ বাদ পড়িল কিনা, আবার তিনি সদয় এর কাগজখানা দেখিয়া লইতেছেন কোন কিছু সদয় করিতে বাকী রহিয়াছে কি না।ক্ষণে ক্ষণে আবার নতুন নতুন বিষয় সদয় তালিকায় স্থান পাইতেছে।বাড়ির বারান্দায় পড়শিদের আসর বসিয়াছে।আসরের মাঝে রহিয়াছেন মিলান মিয়ার মা-পরিজন সহ আরো অনেকে।ক্ষণে ক্ষণে আবার তাহাদের মাঝে কান্নার রোল পড়িতেছে।কেনইবা পড়িবেন? বাড়ির একমাত্র কন্যা পারুর বিবাহ যে দ্বার গোড়ে।
বিবাহের সকল সদয় ক্রয় করা হইয়াছে।তবে কাঁচা তরকারি আর মাছ এখেনো ক্রয় করা হয় নাই।মাছ তিনি নিজের পুকুর থেকেই ধরিবেন। আর কাঁচা তরকারি বিবাহের আগের দিন ক্রয় করিলেই চলিবে।১৬ই  নভেম্বর ২০০৭ কন্যর বিবাহ।যোগাড়যন্তের কোন কমতি রাখেন নাই কন্যার বাপ।আগে ভাগে গরু কিনিয়া নিজ গোয়ালে রাখিয়া তার মেহমানদারি চলিতেছে।সাথে রহিয়াছে এক হালি ছাগল।পারুর চাচা আগে থেকেই ঠিক করিয়াছেন নিজ খামারের অর্ধেক মুরগি পারুর বিবাহে রান্না হইবে।কন্যার চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু, পড়শী সকলেই তাহার বিবাহে কিছু করিবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাইতেছেন।তাহাদের আগ্রহ দেখিলেই বুঝিতে পরা যায়, পারু সকলেরই আদরের কন্য।



চারিদিকে মানুষের সোরগোল পড়িয়াছে।দুইদিন বাদেই রাজপুত্র আসিয়া পারুকে লইয়া যাইবে।পারুর চোখে ঘুম নাই।মনে মনে সে সংসারের ছক আঁকা শুরু করিয়াছে।আজকাল সে নাওয়া-খাওয়া ছাড়িয়াছে।বাপ-মাকে ছাড়িতে হইবে এই চিন্তায় তার নাওয়া-খাওয়া নাই আর ঘুম কাড়িয়াছে রাজপুত্র।তবে পারুর রাজপুত্র মতিনের নাওয়া খাওয়া যায় নাই, শুধু ঘুম নাই।বিবাহের তোড়ে উভয়ই ব্যস্ত।

আগামীকাল বিবাহ।মিলান মিয়া আজই একবার গঞ্জে যাইবেন।কোন কিছু বাদ থাকিলে কাঁচা তরকারির সহিত তাহা লইয়া আসিবেন।এদিকে আবার একদল লোক জাল লইয়া পুকুরে নামিয়া গিয়াছে।পুকুরের চারিপাশে দাড়াইয়া লোকেরা মাছ ধরার দৃশ্য দেখিতেছে।কেউ আবার রং-বেরং এর কাগজ দিয়া বাড়ির উঠান সাজাইতেছে।সদর দরজার দুই পাশে দুই কলাগাছ ও তাহার সহিত রঙিন কাগজ দিয়া একটি ফটক তৈরি করা হইয়াছে।নানা-নানি, পড়শি-স্বজন অধিকাংশ আশিয়া পড়িয়াছে।বাবুর্চিকেও তাড়াতাড়ি আসিবার অনুরোধ করা হইয়াছে।সন্ধ্যার আগেই সে তার দল লইয়া আসিবে বলিয়া আস্বস্ত করিয়াছে।এই কয়েকদিন ধরিয়া আবহাওয়া ভাল যাইতেছে না।রান্নার জন্য আলাদা করিয়া ছাউনীর ব্যবস্থা করা হইয়াছে যাতে করিয়া বর্ষার কারণেও কোনরূপ সমস্যা না হয়।

মিলান মিয়া সদয় শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিতেছেন।বৃষ্টির তেজ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাইয়াছে।তাহার সহিত বাতাসের প্রবল বেগে গাছপালা ভাঙ্গিবার উপক্রম হইয়াছে।গাঁ এর সমস্থ স্থান এবং গঞ্জ সবখানেই মাইকিং করিয়া বিপদ সংকেতের ঘোষণা হইতেছে। এক নয়, দুই বা পাঁচ-সাত নম্বর নয়,এক্কেবারেই দশ নম্বর বিপদ সংকেত।মহাবিপদ আসিতেছে!বিপদের নাম সিড্‌র।শব্দখানি আসিয়াছে সিংহলি থেকে।শব্দের অর্থ শুনলে মাথার মধ্যে চক্কর মাইরা ওঠে।চক্ষুউহার অর্থ।চোখের পর্দা উঠাইলেই যেমন করিয়া সামনের ফাঁকা যায়গায় মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টি চলিয়া যায়, তেমনি করিয়া সিড্‌র ও নাকি সামনে যাহাই পাইবে তাহাই শ্মশান করিবে।সবাইকে নিরাপদে যাইবার জন্য কড়া নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছে।বেতার যন্ত্রে ক্ষণে ক্ষণে ধর্মীয় সংগীত চলিতেছে।তাহারই ফাঁকে ফাঁকে সিড্‌র এর দূরত্ব সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে।
মিলান মিয়া অতি কষ্টে বাড়ি ফিরিয়াছেন।তবে সদয় এর অবস্থা হালুয়া।সবকিছু একাকার হইয়াছে।সময় রাখিয়া তিনি গামছা দিয়া সিক্ত দেহখানি শুষ্ক করিবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাইতেছেন।মাঝে আবার হাতের টর্চটি গোয়ালের দিকে ফিরাইয়া দেখিয়া লইলেন গরু-ছাগলের অবস্থা কিরুপ রহিয়াছে।বাবুর্চি আসিয়াছে।তবে রান্নার যোগাড়যন্তের কোন ব্যবস্থা নাই।পাশের বাড়ির কবির আসিয়া বলিলেন

-এহন আর রান্দনের কাম নাইগো চাচা।বইচ্চা থাকলে কাইল সকালে রান্দন যাইবো।তুমি চাচি আর পারুরে লইয়া যতীনের দালানে যাও।আমরা হক্কলে ওইহানেই আছি।
-ক্যারে কবির,খবরকি বেশি খারাপ নাহি?
-হুম চাচা।প্লাবন তো আমাগো বলেশ্বরের মুহে আইয়া পড়ছে।আল্লায় জানে কি পাপ করছিলাম।আহ তোমরা।আমি সামনে আগাই।
-হুম আহি।তুই আগা।
চোখে মুখে মিয়ার দুশ্চিন্তার ছাপ পড়িয়াছে।বাড়িভর্তি শোরগোল আর নাই।মুহূর্তেই সব মলিন হইয়াছে।এত সদয়,গরু,ছাগল,মাছ,মুরগি সব মিলিয়া মিয়ার মাথা গরম হইয়া উঠিতেছে।পারুকে ডাকিয়া বলিলেন
-পারু তুই তোর মারে লইয়া যতীন জেঠার ওইহানে যা।
-তুমি যাইবানা বাজান?
-না।আমার আর যাইয়া কাম নাই।ঝর ভর্তি সদয়,গোয়ালে গরু-ছাগল।চোর চুট্টার কথা কওন যায়না।সুযোগ পাইলেই ঘর খালি কইরা দিব।

বাবুর্চি ইতিমধ্যে কাটিয়া পড়িয়াছে।পারু আর তার জননী মিলান মিয়ার সাথে  কিছুক্ষণ ব্যার্থ চেষ্টা চালাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছে।হঠাৎ কটমট করিয়া মিয়ার পুকুর পাড়ের সিরিজ কাছটা মূল থেকে ছিন্ন হইয়া পুকুরেই পড়িয়াছে।নদীর পাড়ের গাছগুলি বাতাশের অত্যাচারে মাটিতে লুটাইবার উপক্রম হইয়াছে।বাতাশের গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটারের উর্ধ্বে উঠিয়াছে তাহার সহিত প্রবল বর্ষণ।
মিলান মিয়া কিছুটা ভীত হইয়া পড়িলেন।নিচু স্বরে কহিলেন

-পারু,আর দেরি করিস না।তোরা সামনে আগা,আমি একটু পরে আহি।
কন্যার মনে ভয় ঢুকিয়াছে।কোন কথা না বলিয়া সে তাহার মায়ের সহিত সামনের দিকে পা বাড়াইলো এবং পিতাকে তাড়াতাড়ি আসিবার অনুরোধ করিল।নিজ বাড়ি হইতে দুই-তিন মিনিটের রাস্তা পার হইলেই যতীন বাগচীর দ্বিতল বাড়ি।

চারিদিকে গাছপালা ভাঙ্গার কটমট শব্দ হইতেছে।একলা বাড়িতে মিয়া কন্যার বিবাহের কি হইবে তাহাই ভাবিতেছেন।সকালে উঠিয়া সবকিছুই করিতে হইবে এই চিন্তায় মিয়া অস্থির।তবে যেহেতু প্লাবনে বরপক্ষেরও একই অবস্থা সেহেতু যোগাড়-যন্তে তাহাদেরও সমস্যা হইবে।তাহারা আসিতে দেরী করিবে ভাবিয়া মিয়া একটু আস্বস্ত হইলেন।এসব ভাবিতে ভাবিতে মিয়ার চোখে ঘুম ঘুম ভাব ধরিয়াছে।হঠাৎ তিনি হাম্বা-হাম্বা,ভ্যাঁ-ভ্যাঁ,কক্‌-কক্‌ শব্দ শুনিয়া চোখ মেলিলেন।তারপর কি ঘটিল তাহা মিয়ার জানা নাই।

যতক্ষণে জ্ঞান আসিল ততক্ষণে সব শেষ হইয়াছে।আখি খুলিয়া মিয়া দেখিলেন বিবাহের জন্য কেনা বিশাল আকৃতির ষাড়ের উপর তাহার মাথা রহিয়াছে।চারিদিকে কান্নার ঢল পড়িয়াছে।বলেশ্বর তীরবর্তী পরিবার সমূহের দুঃখের অন্ত রইল না।কাঁচা ঘর থেকে পাকাঘর, ফসল, গাছপালা, পশুপাখি, সব একাকার হইয়াছে।মিলান মিয়া আখি মেলিয়া কন্যার বিবাহের কথা চিন্তা করিয়া বিস্মিত হইলেন।তাহা যে আর সম্ভব হেইবে না তাহা তিনি কল্পনাও করেন নাই।

বিবাহের যোগাড়-যন্তের কোনকিছুরই হদিস নাই।সবকিছুই সিড্‌রে গ্রাস করিয়াছে।মিলান মিয়ার হাত মাথায় উঠিয়াছে।মুখে বোল নাই।হঠাৎ কবিরের চিৎকার শোনা গেল,

-চাচাগো আমার সব শ্যাষ হইয়া গেছে।তোমার বৌমা আর নাই গো চাচা।
-কস কি!
গত রাইতের ঝড়ে কবিরের স্ত্রীর শরীরে গাছ পড়িয়া মাথা থেথলে গিয়াছে।কবিরের স্ত্রী বিয়োগের কথা শুনিয়া মিলান মিয়ার চোখ কপালে উঠিয়াছে,
-কি গো কবির তোর চাচী আর পারু কেমন আছে?
-কও কি চাচা,ওগোর খবর তো তোমার কাছে!
-কস কি!কাইল রাইতে যে ওরা যতীনের দালানে যাওনের লাইগা রওনা হইল।
-নাগো চাচা, ওরা তো আহে নাই।

সব্বনাশ হইছেরে! আমার সব্বনাশ হইছে।আমার আম্মায় কইগো……চিৎকার জুড়ে দিলেন মিলান মিয়া।
মাঝে মাঝে খবর আসিতেছে বিভিন্ন স্থানে মৃতের সংখ্যা ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান সম্পর্কে।আরও খবর আসিতেছে অজ্ঞাত লাশের।মিলান মিয়া কবিরকে সাথে লইয়া নিজের বাড়ির আশেপাশে খোজা শুরু করিলেন।যতীনের জমিনেও খোজা হইয়াছে।কোথাও পাওয়া যায় নাই।হঠাৎ শোনা গেল কবিরের ধান ক্ষেতের ভিতর মিলান মিয়ার স্ত্রীর মৃত দেহ পাওয়া গিয়াছে।স্ত্রীর মৃত্যুর খবরে মিলান মিয়া এ ব্যাপারে নিশ্চিত হইলেন যে তার কন্যা আর নাই।

মিলান মিয়া আর যতীনের বাড়ির মাঝে প্রায় একশ হাত যায়গা শ্মশান হইয়াছে।সেইখানে মাথায় হাত রাখিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছিলেন মিলান মিয়া।সূর্য্ পশ্চিম আকাশে ঢলিয়া পড়িয়াছে।দিনের আলো কমতে শুরু করিয়াছে।সময় যে কাহারও জন্যই অপেক্ষা করেনা তাহা আজ সবাই বুঝিয়াছে।আজ এই বিপদের দিনে সন্ধ্যা একটু দেরিতে হইলে কোন সমস্যা ছিল কি?কিন্তু জগতের চিরন্তন নিয়মে সন্ধ্যা আজও যথাসময়ে ঘনিয়ে আসিতেছে।সামনের শ্মশানরূপ ফাঁকা জায়গাতে হাটু সমান পানি জমিয়াছে।মিলান মিয়া লক্ষ্য করিলেন পানির মধ্যে কাহারও চুল ভাসিতেছে।আরেকটু ভাল করিয়া লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন চুলের সহিত কাপড়ও ভাসিতেছে।তিনি পানির মাঝে দৌড়ানো শুরু করিলেন।সময়ের অপব্যয় না করিয়া ঝোপঝাড় সরাইয়া নিশ্চুপ দেহখানিকে পানি থেকে উঠাইলেন।তারপর যাহা হইবার তাহাই হইলো……………

কন্যার বিবাহের সকল কার্য্ সম্পাদন হইল।এখন শুধু কনে বিদায়ের পালা।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Write a letter to your friends inviting him to your sister’s marriage ceremony

বাংলা বানানে ‘ই-কার‘ এবং ‘ঈ-কার’ এর নিয়ম

বাংলায় মধ্য-অ এর উচ্চারণ