টোকাই


টোকাই



ছোট বেলাতেই শফি পিতামাতা ছাড়া।১৯৫৮ থেকে পূর্ব পকিস্থানে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন।তখন শফির বয়ষ দেড়-দুই বছর।শফির পিতা মাজেদ আলী পেশায় ছিলেন একজন দিন মজুর।৬১ সালে তিনি পাক-সেনাদের হাতে নিহত হন।কি কারনে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল তার কোন হদিস কেউ জানত না।তাঁর স্ত্রী আহেলী খাতুনের ছিল যক্ষা ব্যাধি।স্বামীর মৃত্যুর কয়েক বছর পরই তিনিও বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ খেয়ার সঙ্গী হণ।
শফির বয়ষ তখন সাতপিতামাতার মৃত্যুতে সে এখন একা।আত্মীয় স্বজন যেখানে যারা আছে সবাই নিজেদের চিন্তায় ব্যস্ত।হাজার হলেও শফি একজন মানুষ।পেটের দায়ে তাই সে যশোর ট্রেন স্টেশনে টোকাই হিসেবে কাজ শুরু করে।কিন্তু অত্যাচারের স্ট্রিমরোলারে সমগ্র জাতি যেখানে অভুক্ত,সেখানে টোকাই এর খাবার আসবে কোথা থেকে?
আজ যশোরের এই ট্রেন স্টেশনই তার সবথেকে আপন।সে কোনদিন তাকে দুবেলা অভুক্ত রাখে আবার কোনদিন তিনবেলা।শফি লক্ষ্য করে প্রতিদিন একই পথ ধরে ট্রেন গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি ধরে।তার বাল্য মনেও এই পথ ধরে শহরে যাওয়ার সাধ জাগে।অবশেষে দলের চার-পাঁচজন মিলে ট্রেনে চেপে শহরে চলে এল।




গ্রামের অবস্থা যতটা খারাপ ছিল শহরে তার চার গুন।অত্যাচারের মাত্রা দিনেদিনে তীব্র হচ্ছে।এদিকে সরকার আগরতলা মামলায় বাঙালী নেতাদের জেলে পুরেছে।তারা হত্যা করেছে ছাত্রনেতা আসাদকে। আবার জেলখানাতেই তারা হত্যা করেছে সার্জণ্ট জহুরুল হককে।সর্বোপরি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক .শামসুজ্জোহাকে অমানুষিক ভাবে হত্যার কারনে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্থানে বিরাজ করছে গণঅভ্যূত্থান।এসবের মাঝেই শফিকে থাকতে হয়।অবশ্য থাকা নিয়ে তার কোন চিন্তা নেই।ফুটপাতই তার ঠিকানা।
বয়ষে ছোট হলেও দেশের মানুষকে পাকিস্থানীরা হত্যা করে,তাও আবার বিনা অপরাধে, এসব ঘটনা শফির মনে পাকিস্থানীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জাগিয়ে তোলে।রাতে ফুটপতে ঘুমানোর সময় তারা জীবিত ঘুমায় আর সকালে উঠে দেখে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজ্ঞাত লাশ।না ওরা অজ্ঞাত নয়। ওরা বাঙালী।শফির ইচ্ছা হয় সেও পাকিস্থানী হানাদার দের এভাবেই হত্যা করবে।কিন্তু চাইলেই কি আর সব সম্ভব?
লেখাপড়া না জানলেও বুদ্ধিতে সে বেশ পাকা।উর্দু ভাষা যথেষ্ঠ জানলেও সে সব সময় বাংলাতেই কথা বলে।কেননা সে জানে শত মায়ের অশ্রুর বিনিময়ে অর্জিত পৃথিবীর একমাত্র ভাষা বাংলা। শফি ভাবে আর ওর শরীরের পশমগুলি দাড়িয়ে যায়। এসব ইতিহাস শফি সব লোকদের কাছথেকে জেনেছে যারা প্রতিদিন গাড়ির জন্য রাস্তার পাশে আপেক্ষা করে আবার গাড়ি পেলেই গন্তব্যে রওনা হয়।সে একদিনে জানেনি গল্প। একজন গল্প বলতে বলতে গাড়ি চলে আসে, সে চলে যায়।কিন্তু শফির আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না।পরের দিন অন্য কেউ এলে সে তার কাছে ছুটে যায় এবং মিনতি করে বলে
-‘কাকা আমাগো দেশের মাইনশে নাকি বাংলায় কতা কওনের লাইগ্যা পুলিশের আতে গুলি খাইয়্যা মরছিল? কেচ্ছাডা আমারে এট্টু কইবেন?’ 
কেউ বলে আবার কেউ থাপ্পড় মেরে দূর করে দেয়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১,মিলিটারিরা পূর্ব পাকিস্থানের সর্বস্তরের মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে।শফি তখন ফুটপাতে বস্তা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।হাজার হাজার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদ স্থানের খোঁজে পালাচ্ছে।গাছের হলুদ পাতা যেমন শীতের প্রকোপে ঝরতে থাকে, মানুষও তেমনিভাবে ঝরে পড়ছে।কেউ জীবিত,কেউ মৃত, আবার কেউ আধা মৃত।সকলে ভয়ে পালালেও শফির মনে ভয়ের কোন আভা জাগেনি।প্রচণ্ড ক্ষোভে তার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।হঠাৎ মিলিটারির গাড়ির গড় গড় আওয়াজ শোনা গেল।শফির আর সহ্য হয় না।এক দৌড়ে সে রাস্তার মাঝে মিলিটারির গাড়ির সামনে চলে এল। গাড়ির সামনে ১০-১১ বছরের বালকের হঠাৎ আগমনে গাড়ি ব্রেক করা হল। চারিদিকে স্তব্ধ। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল......
আপনারা আমাগোরে মারেন ক্যান?আপনাদের দ্যাশে যাইতে পারেন না? আমাগো দ্যাশে থাহেন ক্যান? আপনারা আমাগো খালি মারেন.....’ 



হঠাৎ ঠাশ ঠাশ করে দুটি শব্দ হল।শফির কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে গেল...........
আমাগোর..মারেন..ক্যান?’



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Write a letter to your friends inviting him to your sister’s marriage ceremony

বাংলা বানানে ‘ই-কার‘ এবং ‘ঈ-কার’ এর নিয়ম

বাংলায় মধ্য-অ এর উচ্চারণ