যাত্রা


যাত্রা


শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বরই দিন ঠিক করা হলো। আমার ফুফাতো বোনের বিয়ে। দুই দিন আগে ডিসেম্বর সকালে আমি ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম। ফুফার বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলে। ঢাকা থেকে বাসে একদিনের পথ। আমার আসনটি ছিল মাঝামাঝি।আমি আমার আসনটিতে বসলাম এবং যথা সময়ে বাস ছাড়ল। বাস তখন পূর্ণ গতিতে চলছে। হঠাৎ আমার পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার বিপরীত পাশে দেড়-দুই বছরের একটি বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।কি মিষ্টি হাসি! বড় বড় দুটি চোখ,মোটা সোটা দেহ আর তার সাথে বাচ্চাটির চাঞ্চল্যতা সবকিছু এতই সক্রিয় ছিল যে, আমার হাত দুটি না বাড়িয়ে পারলাম না।বাচ্চাটির পাশে ছিল ওর মা এবং তার পাশের সিটে বসা বৃদ্ধ লোকটি ওর নানা। অবশ্য এসব আমি পরে জেনেছি



সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা দেখলে কার না ইচ্ছা হয় তাকে কোলে নিতে, আদর করতে? আমি আমার হাত দুটি বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু হাত বাড়াতেই বাচ্চাটির মা বলে উঠলেন

- ‘না দাদা, আমার মাইয়্যার এইডচ হইছে

কিছুটা বিস্মিত হলাম।পরে অবশ্য বুঝতে পারলাম ঊনিএইডচবলতে এইডস এর কথা বলেছেন। বাসের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।কিছু কিছু মানুষ যে কোন বিষয়ে জানুক অথবা না জানুক নেগেটিভ ধারনা করে বসে থাকে। তাছাড়া অন্য কিছু পারুক বা না পারুক সমালোচনায় তারা ফার্স্টক্লাস।আমাদরে সমাজে এই শ্রেনীর মানুষের সংখ্যা নিতান্তই বেশী।চোখের সামনে এইডস রোগী পেয়ে তাই বাসের ভিতরে বসে থাকা সমাজের নিন্ম মানসিকতার এইসব মানুষগুলো একটু নড়ে চড়ে বসলেন। ইতিমধ্যে একে অপরের সাথে কানাকানি ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বাচ্চাটির বাবা-মাকে দোষ দিচ্ছেন।আবার কেউ কেউ বিনা খরচে অশ্লীল ভাষায় তাদের চরিত্রে কালিমা লেপন করছেন। তবে মানুষ গুলোর কথা শুনে বুঝতে পারলাম বাঙালী আজওএইডসবলতে শুধুমাত্র নারী-পুরুষের অবাধ অবৈধ সম্পর্ককেই বোঝেন।কিন্তু ওটাতো পরের কথা মানুষের এমন মতামত শুনে বাচ্চাটির মায়ের জোখে জল এসে গেল।

তখনও আমার হাত দুটি বাচ্চাটির দিকেই ছিল। আমার কোন খেয়াল তখন ছিল না।বাচ্চাটির মাকে বললাম-

- ‍আপা ওর নাম কি?
-তিনি বললেনরঞ্জনা
বুঝে গেলাম যে মেয়েটি হিন্দু। আর যখন দেখলাম তার মায়ের কপালের সিঁদুর বা হাতের শাখা কোনটাই নেই তখন আর বুঝতে বাকি রইলনা যে রঞ্জনা একজন হতভাগী,এতিম।হাফ ছেড়ে বললাম
- দিদি...রঞ্জনাকে আমার কাছে দিন!
তিনি বললেন
-দাদা তাইলে আপনারও এইডচ অইবার পারে।
বুঝে গেলাম ঊনি এইডস কে ছোয়াছে রোগ মনে করেছেন।
হাসতে চেষ্টা করে বললাম
-আপনার কোন সমস্যা হবে না?
উত্তরে তিনি বললেন-’আমিতো এমনেও শ্যাষ অমনেও শ্যাষ


দিদি কোন সমস্যা হবেনা। এইডস কোন ছোয়াছে রোগ নয়। ওকে কোলে নিলে আমার বা আপনার কারও কোন সমস্যা হবেনা। তাছাড়া এইডস রোগীর সাথে চলাফেরা,একই সাথে খাবার খাওয়া,গোসল করা, একই বিছানায় ঘুমানো, একই গ্লাসে পানি পান করা প্রভৃতির মাধ্যমে এউডস ছড়ায়না। এটি এইচআইভি [HIV] নামক এক প্রকার ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারনত নিন্মোক্ত কারনে এইডস হয়ঃ-

-স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন নারী বা পুরুষের মাঝে কনডম ছাড়া অবাধ অবৈধ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এইডস ছড়াতে পারে।

-ইঞ্জেকশনের জন্য একই সূঁচ বা সিরিঞ্জ একাধিকবার ব্যবহার করলে

-আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কনডম ছাড়া যৌনক্রিয়া করলে
-আক্রান্ত রোগীর রক্ত বা অন্যকোন শারিরীক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণের মাধ্যমে
-এইডস আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ পানের মাধ্যমে
-পিতামাতার কোন একজন আক্রান্ত হলে আগত সন্তানসহ তাদের উভয়েরই এইডস হতে পারে

আমার কথার প্রতি উনার কোন খেয়াল ছিলনা।আনমনে বসে কি যেন চিন্তা করছিলেন।একমাত্র মেয়ে রঞ্জনা,তার এই দূরারোগ্য ব্যাধিই সম্ভবত তার মায়ের মুখের হাসি,আহার,চোখের ঘুম সবই কেড়ে নিয়েছে।রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।রঞ্জনা তখন আমার শার্টের বোতাম নিয়ে খেলা করছে।দিদির কাছে প্রশ্ন করলাম যে তারা কোথায় যাবেন। উত্তরে তিনি বললেন যে তারা বাগেরহাটে যাবেন।খান জাহান আলী(রহঃ) এর মাজার এর কাছাকাছি কোথাও বাড়ি।আমি মনে মনে একটু আনন্দিত হলাম।দেশে বা বিদেশে অপরিচিত মানুষের ভিড়ে নিজ দেশ বা এলাকার কেউকে পেলে যা হয়, আমারও তাই হল।সকাল ১০টার দিকে আমরা পদ্মায় পৌঁছলাম। লঞ্চে করে নদী পার হতে হবে।


রঞ্জনা তখনও আমার কোলেই ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই রঞ্জনার প্রতি আমার গভীর মায়া তৈরি হয়ে গেল

দুপুর টার দিকে আমরা খানজাহান আলীর মাজার সংলগ্ন স্টেশনে নামলাম।অবশ্য এটা আমার গন্তব্য ছিল না।এর আগের স্টেশনেই আমার নামার কথা ছিল। কিন্তু তবুও আমি একটু পরে রঞ্জনার সাথে নামলাম এবং তাদের বাড়িতে গেলাম।স্টেশন থেকে কিছু পথ হেঁটে যেতে হয়। গ্রামের ভিতরের পথ। আশেপাশে এলাকাবাসীদের বাড়িপথে যাদের সাথে দেখা হচ্ছে সকলেই তাদের ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করছে। গ্রমবাসীও কানাকানি ফিসফিসানিতে পিছিয়ে নেই। তবে তাদের প্রত্যেকের ধারনা পিতা অথবা মাতা কোন একজনের অপকর্মের ফলে রঞ্জনার আজ এই দূর্ভোগ।কিছুক্ষণ বাদে আমি আমার ফুফার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।রঞ্জনা তখন ঘুমাচ্ছিল

বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে প্রায় এক মাসের মত বাড়িতে থাকতে হয়েছিল আমাকে। মাঝে মধ্যে আমি রঞ্জনাকে দেখতে যেতাম।দিনে দিনে রঞ্জনার শারীরে ব্যাপক অবনতি হচ্ছে।মাত্র কয়েকদিন আগের সেই রঞ্জনা আর আজকের এই রঞ্জনার মধ্যে অনেক তফা তৈরি হয়েছে। সে এখন আর আগের মত ছটফট করে না। কাউকে দেখলেই তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েনা।সে এখন নীরব, স্তব্ধ। আর গ্রামের সকলের মুখে সেই একই কথা।রঞ্জনার কাছে কেউ যাচ্ছেনা। তার খাবার পাত্র,বিছানা, পানির পাত্র সবই আলাদা।এত মানুষ চারিদিকে কিন্তু রঞ্জনা বড়ই একা।ঘরের বারান্দায় একটি বিছানায় স্থান হয়েছে তার। আর তার চারপাশে রয়েছে খাবার পাত্র হিসেবে একটি থালা আর একটি গ্লাস।মাঝে মধ্যে তার মা এসে মেয়ের দেখাশুনা করছেন। দূরন্ত শিশুটির এরূপ একাকীত্ব দেখে আমার চোখের কোনে জল এসে গেল। কাছে গিয়ে কোলে নিলাম শিশুটিকে। পরম আদরে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। আশেপাশের মানুষ গুলো তখন আমাকে নিয়েও ভাবনায় পড়ে গেলেন। এবার বুঝি আমাকেও এইডসে ধরে

এইডস আক্রান্ত শিশুর খবর পেয়ে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ আসছে তাকে দেখার জন্য। হিন্দু-মুসলমান সকলেই আসছে। সকলেই দূর থেকে পিতামাতার সমালোচনা আর মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য প্রার্থনা করছে। তবে কেউ রঞ্জনার কাছে যাচ্ছে না। কেউকেউ আবার এইডস সম্পর্কে আলোচনা করছে এবং তা থেকে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজছে।সুযোগটাকে আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম।তাদেরকে এইডস থেকে বাঁচার উপায় জানাতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আমার ধারনা রঞ্জনাকে দেখার পর তাদের মধ্যে যে ভীতির উদয় হয়েছে তাতে এইডস রোগের উৎপত্তি কোথাথেকে,কোথায় রোগী বেশী, প্রতিদিন কি পরিমান লোক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং কতজন মারা যাচ্ছে এসব আলোচনা মুখ্য বিষয় নয় বরং কিভাবে এইডস থেকে বাঁচা যাবে এটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ

আমার পাশে অনেক লোক জমা হয়েছে। ছেলে, বুড়ো,পুরুষ, মহিলা, হিন্দু-মুসলমান সকলেই আছে। আমি গুটি গুটি পায়ে রঞ্জনার দিকে গেলাম। তাকে কোলে নিতেই সকলে বিস্মিত হলো। আমি তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে এইডস কোন ছোঁয়াছে রোগ নয়।তাছাড়া মাত্র কয়েকটি বিষয়ে সচেতন থাকলে এইডস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা যায়।যেমনঃ

-ধর্মীয় সচেতনতা এইডস প্রতিরোধে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

-ইঞ্জেকশনের একই সুঁই বা সিরিঞ্জ একাধিক বার ব্যবহার না করা।
-অপরেশনের অস্ত্র ভালকরে ফুটন্ত পানিতে ফুটিয়ে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত করে দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা।
-রক্ত গ্রহণের সময় রক্তে এইডস রোগের বাহক এইচ.আই.ভি. ভাইরাস আছে কিনা তা ভালভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া।
স্বা-মী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন নারী বা পুরুষের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা।
-এইডস আক্রান্ত মায়ের দুধ থেকে সন্তানকে মুক্ত রাখা



আমার কথাগুলো সকলেই মনযোগ সহকারে শুনলেন।রঞ্জনা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার সেই চাঞ্চল্যতা এইডসের ঘাতকতায় আজ বিলীন


দীর্ঘ দিন পর ঢাকা ফেরার পালা।সন্ধ্যার টিকিট বুকিং দেওয়া রয়েছে।আবার কতদিন পর গ্রামে আসা হবে তার ঠিক নেই।তাই ঠিক করলাম আরেকবার রঞ্জনাকে দেখে আসি।ফুফাতো ভাই এর বাই সাইকেলটি নিয়ে রওয়ানা হলাম।যতটা সম্ভব দ্রততার সাথে সাইকেল চালাচ্ছিলাম।কিছুক্ষণ বাদেই ষাটগম্বুজ মসজিদের কাছে এসে পড়লাম।কি মনে করে যেন দাড়ালাম। সাইকেল থেকে নেমে দোকান থেকে কিছু চিপস, খেলনা এবং হরলিক্স কিনলাম। আবার দ্রুততার সাথে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম।গ্রামের ভিতর ঢুকতেই গ্রামটাকে কেমন স্তব্ধ মনে হলো। আমি সামনে এগোতে থাকলাম

যতক্ষনে পোঁছলাম ততক্ষণে সবাই রঞ্জনার শেষ যাত্রার ব্যবস্থা করছে.......................




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Write a letter to your friends inviting him to your sister’s marriage ceremony

বাংলা বানানে ‘ই-কার‘ এবং ‘ঈ-কার’ এর নিয়ম

বাংলায় মধ্য-অ এর উচ্চারণ