মানিক


মানিক

এই জগতে পিতা-মাতার স্নেহের তুল্য আর কি হইতে পারে? শৈশবে তাহাদের পরম স্নেহের কারনেই বোধকরি একটি শিশু অজানা-অচেনা পৃথিবীতে আসিয়া তাহাকে আপন করিয়া লয়।এক বেলা আহার না করিলে দুঃখ নাই কিন্তু রাত্রি কালে মাতৃক্রোড়ে শায়িত হইবার সুযোগ হারাইলে কষ্টের অন্ত থাকেনা। বোধকরি এইরূপ যন্ত্রনাই মানিকের ওপার যাত্রার অন্যতম প্রধান কারন। 



গাঁ এর এক একান্নবর্তী পরিবারে পরিবারে জন্ম মানিকের। জগতের আর পাঁচ-দশটা কঁচিকাঁচার মত মানেকের আবির্ভাব পিতামাতাকে আনন্দ দিতে পারে নাই। কেননা নিত্যদিনের সাংসারিক অভাবের মাঝে নতুনের আগমন পিতার মস্তকে বাড়তি চিন্তা ঢুকাইয়াছিল।গরীবের সংসারে অভাবের সহিত নিত্য দিনের আরেকজন সঙ্গী আছেন,উনার নাম বিবাদ। এই অভাব আর বিবাদে পড়িয়া বছর পাঁচেক বয়ষেই মানিক এতিম হইলেন।তবে পিতৃ বিয়োগের বিন্দুমাত্র প্রভাব মানিকের কঁচি মনে পড়েনাই। আর পড়িবেইবা কেমন করিয়া? যেই মনে আজ অবধি কোন কিছু পাইবার স্বাধই পূর্ণ হইয়া ওঠে নাই সেইখানে হারাবার অনুভূতি কেথা হইতে আসিবে?

বাটীময় ক্রন্দোনের রোল পড়িয়াছে।মানিকের দাদি,ফুফু,কাকা,কাকি,প্রতিবেশী সকলেই শেষবারের মত স্বজনের সুখময় স্মৃতি সমূহ স্বরণ করিয়া নয়ন জলে বক্ষ ভিজাইতেছে।মানিকের মাতার চোখে জল নাই। অভাগীর চোখের সব জল শুকাইয়া গিয়াছে। স্তব্ধ হইয় সোনার মানিকরে বুকে লইয়া অভাগী থাকিয়া থাকিয়া জ্ঞান হারাইতেছে।সকলের ক্রন্দোনের সহিত মানিকও কাদিতেছে। তবে কেন কাদিতেছে তাহা তাহার জানা নাই।প্রতিবেশী আর স্বজনেরা মিলিয়া মানিকের পিতার দাফন- কাফনের ব্যবস্থা করিয়াছে। এখন শুধু চির বিদায়ের অপেক্ষা।

স্বামীর অকাল যাত্রায় মানিকের জননী বড় একা হইয়া গেলেন।অভাগীর দুশ্চিন্তার শেষ নাই।অন্ন-বস্ত্রের চিন্তা জগতের সর্ববৃহৎ দুশ্চিন্তা।একমাত্র সন্তান মানিকের লেখাপড়া,অন্ন,বস্ত্রের যোগান প্রভৃতি দুশ্চিন্তায় অভাগীর নিদ্রা নাই। তাহার উপর অভাবের সংসার।অবশেষে সিদ্ধান্ত হইল মানিককে স্থানীয় এতিমখানায় ভর্তি করা হইবে।এতে করিয়া তাহার অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা যেমন হইবে তেমনি তাহার বিদ্যা-শিক্ষারও একটা ব্যবস্থা হইবে


গাঁয়ের আর পাঁচ-দশটা বালকের ন্যায় মানিক ছটফটে প্রকৃতির ছিলনা। অন্যের সিদ্ধান্তই তাহার জন্য চুড়ান্ত ছিল।কেহ কিছু বলিলেই সে শুধু মাথা নাড়াইয়া সম্মতি জানাইত অন্যথায় চুপ করিয়া থাকিত।যেই দিন তাহাকে এতিমখানায় লইয়া যাওয়া হইল সেই দিনেও সে বুঝিতে পারে নাই যে তাহার জীবনের পরক্ষনে তাহার জন্য কি অপেক্ষা করিতেছে।জননীর সহিত ভরদুপুরে এতিমখানায় উপস্থিত হইবার পর হস্তি আকৃতির একজন শিক্ষক আসিয়া তাহাকে ভর্তি করিয়া লইলেন।অতঃপর একজন বালককে ডাকিয়া মানিককে লইয়া আহার করিতে যাইবার নির্দেশ প্রদান করিলেন।জননীক ছাড়িয়া যাইবার প্রক্কালে মানিকের কচি মন কাদিয়া উঠিল। জননীর ছলছল আঁখি দেখিয়া সে অনুধাবন করিতে পারিলে যে সে আজ হইতে একা।জগতের মাঝে সে এখন একটি বোঝা মাত্র। যেই মাতৃক্রোড় সন্তানের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল সেখানেই যখন মানিকের স্থান হইলনা তখন আর কে তাহাকে গ্রহণ করিবে? 


আহার সারিয়া মানিক সদর দরজার দিকে জননীর খোঁজে রওয়ানা হইল। এদিকে ওদিকে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও যখন জননীকে পাইলনা তখন সে বুঝিতে পারিল যে জননী তাহাকে ফাঁকি দিয়াছে।তাহার কঁচি মনে ব্যাথার উদয় হইল। ভীষণ কষ্টে তাহার আঁখি জলে গণ্ড ভিজিয়া গেল।খেলার মাঠের পূব দিকের পেয়ারা গাছটার নিচে বসিয়া সে আপন মনে নয়ন বারি ঝরাইতেছিল।হঠাৎ করিয়া একজন টুপিওয়ালা আসিয়া তাহাকে বেদম প্রহর শুরু করিলেন কেননা তখন ছিল তাহার আরবি শেখার সময়। সুতারাং এই সময়ে পাঠশালে উপস্থিত না থাকার দরুন তাহাকে বেদম প্রহর করা হইল। 

মানিকের নানা দক্ষিণের এক ছেলের সাথে কন্যার বিবাহ ঠিক করিয়াছেন। যদিও এই বিবাহতে মানিকের জননীর পূর্ণাঙ্গ মতামত ছিল কি না তাহা আমার জানা নাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানিকের জননীর দ্বিতীয় বিবাহ হইলনতুন পরিবারে মানিকের জননীর ঠাই হইলেও মানিকের ঠাই হইলনা। মানিকে তহার আসল ঠিকানা এতিমখানাতেই ছিল। স্বীয় জননীর দ্বিতীয় বিবাহের খবর তাহার অবধি পৌঁছে নাই।

এতিমখানায় অযত্নে অবহেলায় মানিকের নীরব কঁচি মন বড় হইতে লাগিল। মাঝে মধ্যে তাহার জননী তাহাকে দেখিতে আসিত। কখনও বা তার নানা বা নানী তাহাকে দেখিতে আসিত। মানিক তাহাদের সহিত চলিয়া যাওয়ার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালাইত।দিনে দিনে তাহার অবস্থার অবনতি হইতে শুরু করিল। নাওয়া-খাওয়ার জন্য কেউ অনুরোধ করে না। অযত্ন আর অবহেলায় উহার নাওয়া-খাওয়া আজ নাই বলিলেই চলে।

শ্রাবনের শেষভাগে এতিমখানার ডক্তার মশাই মানিকের জননীর কাছে চিঠি পাঠাইলেন। চিঠির মূল বক্তব্য এইরূপ ছিল..............


মানিকের কঠিন ব্যামো হইয়াছে। দীর্ঘদিন ধরিয়া তাহার সেবা করা হইতেছে কিন্তু কোন ফল পাওয়া যাইতেছে না। বিড় বিড় করিয়া কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেছে কিন্তু তাহা বুঝিবার উপায় নাই। সুতারাং যথাশীঘ্র যেন মানিকের জননী তাহার সহিত দেখা করিয়া কিছু দিনের তরে হইলেও মানিককে গৃহে লইয়া যায়।


খবরটি মানিক জননীর কাছে পৌঁছাই নাই। কিভাবে পৌঁছাইবে তাহার ঠিকানা তো এখন পরিবর্তিত হইয়াছে।তবে খবরটি মানিকের কাকার কাছে গিয়া পৌঁছাইলো।তিনি আবার তাহা মানিকের জননীর কাছে পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিলেন।খবর পৌঁছাইবার এইরূপ দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে অবশেষে একদিন সকলের নিকটই খবর পৌঁছাইলো এবং অবশেষে একদিন মানিকের জননী,কাকা এবং মামা বিভিন্ন প্রকার ফলমূল লইয়া মানিককে দেখিতে আসিলেন।এতিমখানার সদর দরজায় আসিলে তাহাদের পরিচয় পাইয়া টুপিওয়ালা লোকটি ছলছল চোখে তাহাদের বলিলেন-

- ‘বড়ই শান্ত স্বভাবের পোলা ছিল মানিক। 

তারপর তিনি খেলারমাঠের পশ্চিম দিকের আমতলায় একটি ফাকা যায়গা দেখাইয়া বলিলেন -

- ‘ খানে কবর দেওয়া হইয়াছে মানিককে। যান একবার দেখিয়া আসেন। 

জগতের আকস্মিকনিয়ম অনুযায়ী ততক্ষণে চারিদিকে কান্নার রোল পড়িয়াছে.............!!





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Write a letter to your friends inviting him to your sister’s marriage ceremony

বাংলা বানানে ‘ই-কার‘ এবং ‘ঈ-কার’ এর নিয়ম

বাংলায় মধ্য-অ এর উচ্চারণ