পিতা
পিতা(১৩.০৬.২০১৪)
জগতে পিতামাতার স্নেহ বা আদর কোনটাই বদির ভাগ্যে জুটে নাই।ভূমিষ্ঠ হইবার পূর্বেই পিতামাতার বিচ্ছেদ বদির ভাগ্য থেকে পিতৃস্নেহ ছিনিয়া লইয়াছে।ভূমিষ্ঠ হইবার পর পিতার পরিচয় পাইলেও পিতার সহিত তাহার সাক্ষাত হইয়া ওঠে নাই। সুতরাং পিতাকে সে নামে চিনিলেও বাস্তবে চিনে না।
জগতে আসিবার পূর্বেই যাহার পিতৃস্নেহ বিলীন হয় উহার ভাগ্য কতটা সুপ্রসন্ন কেবলমাত্র বিধাতাই তাহা বলিতে পারেন।কোন মানুষের পক্ষে তাহা অনুধাবন করা সম্ভব নয়।আর সম্ভব নয় বলেই বদির ভাগ্য তাহাকে দ্বিতীয়বার ফাঁকি দিল। তাহার মাতার দ্বিতীয় বিবাহ তাহাকে নিঃশ্ব করিয়া দিল। জগতে তাহার আর কিছুই রইল না।এরুপ পরিস্থিতিতে উহার চিরবিদায় হইলেও আকস্মিক হইবার কিছুই ছিল না।কিন্তু বিধাতা তাহা করেন নাই। বোধ করি এই না করার পেছনে গভীর কোন রহস্য লুকায়িত আছে যাহা আমাদের পক্ষে উদঘাটন করা সম্ভব নয়।
কঁচি মন পিতামাতার অভাব বুঝিতে পারে না।পিতামাতার স্নেহ আবশ্যক নয় আবশ্যক একটুখানি স্নেহ। তাছাড়া যেখানে কোন পাওয়া নাই সেইখানে না পাওয়ার অনুভূতি আসিবার প্রশ্নই ওঠে না।পিতামাতা না থাকিলেও দুঃখ নাই কেননা গ্রামের সকলেই তাহার অতি আপনজন।বদির প্রতি তাহাদের স্নেহ ভালবাসার কমতি নাই।লেখাপড়াতে তিাহার কমতি নাই।পরীক্ষার ফলাফল দেখিলে বুঝিবার ইপায় নাই যে এই বালকের পিতামাতা থাকিয়াও নাই।বদির বর্তমান ঠিকানা তার মাতামহের বাড়ি।একমাত্র নানিই তাহার অভিবাবক। গাঁয়ের সকলের ছোট খাট কাজগুলি বদি নিজহস্তে করিয়া দেয়।ইহার বিনিময়ে সে পয়শা পায়।উহা দ্বারা তাহার পাঠশালার খাতা কলম কিনিবার ব্যবস্থা হয়।আদব-কায়দায় বদি গাঁয়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।অন্যান্য পিতা-মাতারা তাহাদিগের সন্তানদেরকে বদির মত হইবার নির্দেশ দেয়।বয়ষে ছোট হইলেও তাহার অনেক কাজ।মাঝে মধ্যে সে গাঁয়ের মালিকানাহীন ডোবার পানি সরাইয়া মাছ ধরে।ইহা বিক্রি করিয়া তাহার স্কুলের টিফিনিরে পয়সা জোগাড় হইয়া যায়।
আজ বদি ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে উঠিয়াছে।গাঁয়ের সকলেই তাহাকে বাহবা দিচ্ছে
-কি বদি সিক্সে উইটা গেলা?
-হ-চাচা।
-ভাল-ভাল,মনদিয়া পড়ালেহা কর মিয়া,তোমারে কিন্তু আর্মি অওন লাগবো।
-জ্বি চাচা, দোআ কইরেন।
-তোমার মায়ে কি খবর পাইছে?
-কইতে পারি না।
-এহন যাও কই?
-হাটে যামু চাচা।মনি চাচায় কইছে আইজ অইতে আমার কোন কাম নাই। আমার কাম অইলো চাচার লগে তার কাঁচা তরকারি দোকানে থাকা।ইস্কুলের মাইনেও চাচায় দিব লগে তিনবেলা খাওন।
-বাহ!বাহ! চমৎকার কাম পাইছো মিয়া।মনিরে আল্লায় বাচায় রাহুক। যাই মিয়া।
-আচ্ছা চাচা।
সকালে স্কুল আর বিকালে দোকানে থাকিয়া বানিজ্য করা বদির নিত্য দিনের কর্ম।মাস্টার মশাইয়েরা বদির অত্যন্ত আপনজন।তাহাদের স্নেহ ও মমতা বদিকে লেখাপড়ায় বাড়িতি উৎসাহ প্রদান করিয়া থাকে।মাঝে মধ্যে বদি তাহার মায়ের সহিত সাক্ষাত করিতে যায়।তবে পিতার সহিত তাহার কোন সাক্ষাত আজ অবধি হইয়া ওঠে নাই।
এ বছর বদি অষ্টম শ্রেনীতে উঠিয়াছে।মাস্টার মশাইয়েরা এবং গাঁয়ের সকলেই বলিতেছেন বদি বৃত্তি পরীক্ষা দিবে।উহাকে আল্লাহ মেধা শক্তি দিয়াছেন সুতরাং বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়াই লাগিবে।স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ভাষ্য এই যে, বদি বৃত্তি পরীক্ষা না দিলে কেউ দিতে পারিবেনা।তিনি নিজে বদির পরীক্ষা দেওয়ার সকল ব্যবস্থা করিয়াছেন।
যেইদিন বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হইল সেইদিন দেখা গেল বদি বৃত্তি পাইয়াছে।গাঁয়ে আনন্দের কমতি নাই।সকলকে খুশির খবর দিয়া মাস্টার মশাই চলিলেন মনির দোকানের তরে।বদি সেখানেই রহিয়াছে। খবর খানি তাহাকে দেওয়া লাগিবে।
-আস্সালামু ‘আলাইকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুমুস্ সালাম,একটা বড় খবর আছেগো বদি।
-কি স্যার?
-তুমি পাশ করছ!তুমি বৃত্তি পাইয়াছ বলিয়া মাস্টার মশাই বদিকে বুকে জড়াইয়া লইলেন।তাহার দুচোখের বারি স্বীয় বাধা না মানিয়া চক্ষু হইতে বাহির হইয়া গেল।
বিকালে একজন ভদ্রলোক দোকানে আসিলেন এবং বদিকে নানারুপ প্রশ্ন করিতে লাগিলেন...
-তোমার নাম কি বাবা?
-বদি,আমার নাম বদি।তয় আপনি কে চাচা?
-তোমার পিতার নাম কি?
বদি তাহার পিতার নাম বলিল।অতঃপর লোকটি তাহার মাতার নাম ও ঠিকানা জানতে চাইলে বদি তাহা মাতার নাম এবং বর্তমান ঠিকানা বলিল এবং বলিল
-আপনে কিন্তু আপনার পরিচয় দেননাই চাচা।
-আমি তোমার পিতার মত, মনে কর আমিই তোমার পিতা।
-কেন মনে করিব?আপনি আমার পিতা হইতে যাইবেন কেন?
লোকটি কোন উত্তর না দিয়া চলিয়া গেল। এভাবে কয়েকদি কাটিয়া গেল লোকটি মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রকার ফলমূল ও খাবার লইয়া বদির নিকট আসিতেন।বদি লক্ষ্য করিল ধীরে ধীরে লোকটির প্রতি তাহার অদ্ভুত এক মায়া জন্মাইতেছে।লোকটির অসম্ভব স্নেহ ও মমতায় বদি যেন তাহার পিতার অনুভূতি পাইতেছে।আজ তিনি কিছু খেজুর লইয়া আসিয়াছেন।
-কেমন আছ বাবা?
-জ্বি চাচা ভালো।আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ,আমি ভালো আছি।এই পথ দিয়া যাচ্ছিলাম।ভাবলাম তোমার লগে একবার দেখা কইরা যাই।নাও খেজুর খাও।
বদি খেজুর খাইতে খাইতে বলিল
-চাচ আপনি কিন্তু আপনার সঠিক পরিচয় আজও দেন নাই।
-আমার পরিচয় রাহ মিয়া।তোমার জন্য একখান গরম খবর আছে মিয়া।
-কি খবর?
-আমি তোমার পিতার সন্ধান পাইয়াছি।অতি শীঘ্র তাহা তোমাকে জানাইব।
বদি নিশ্চুপ রহিল।না পাওয়ার বেদনা পাওয়ার আশায় সঞ্জীব হইল।
দীর্ঘদিন অতিবাহিত হইয়াছে।কিন্তু অজ্ঞাত লোকটি বদির সহিত সাক্ষাত করে না।এদিকে বদির আপন পিতার সহিত সাক্ষাতের জন্য আর দেরী সহ্য হয় না।পিতার সহিত সাক্ষাত হইলে সে কি বলিবে, কিভাবে তাহার দীর্ঘদিনের অভিমান ব্যক্ত করিবে মনে মনে তাহার ছক অঙ্কন করিতে করিতে বদির বর্তমান দিনগুলো অতিবাহিত হয়।যেন তাহার হৃদয়ে পিতৃস্নেহ অনুভূত হইতাছে।
একদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়িয়া বদি তাহার বইপত্র গুলি ঘাটিতছিল।এমন সময় একজন লোক সাইকেলে চড়িয়া এবং বদির নানিকে সালাম প্রদান পূর্বক কহিল
-মতি মিয়া আর নাইগো চাচি....
-কস কি শহীদ!কি অইছে মতির?
-কাইল রাইতে মারা গেছে।তোমার নাতিরে পাঠাই দিও।
বদি কিছু বুঝিতে পারিল না।ভেজা গলায় কহিল
-কোন মতি নানি?
-তোর পিতা।
শুনিয়া বদি স্তব্ধ হইয়া গেল।এতদিন ধরিয়া পিতার সহিত সাক্ষাতের যে দীর্ঘ প্রতিক্ষা তাহা শেষ হইবার উপক্রম হইল।কোন কথা না বলিয়া বদি তাহার শহীদ চাচার সহিত রওয়ানা হইল।যতক্ষণে পৌঁছাইলো ততক্ষণে সকলে মতি মিয়ার গোসলের ব্যবস্থা করিতেছে।বদিকে তাহার পিতাকে দেখিবার জন্য পাঠানো হইল।পিতার দেহ দেখিবার মাত্রই বদি জ্ঞান হারাইলো।এতক্ষণে সে বুঝিয়াছে কেন অজ্ঞাত লোকটি বদিকে তাহার পিতার সহিত সাক্ষাত করাইতে পারেনাই।কেমনে পারিবে সেই যে বদির পিতা..............
পিতার সহিত প্রথম সাক্ষাতেই চিরতরে হারাইবার বেদনার পাশাপাশি এত কাছে পাওয়া সত্ত্বেও পিতাকে পিতা বলিয়া ডাকিতে না পারার বেদনায় বদির জ্ঞান হারানোই স্বাভাবিক ছিল।যতক্ষণে জ্ঞান আসিল ততক্ষনে পিতাকে চিরবিদায়ের সময় হইয়াছে।
মন্তব্যসমূহ